স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ
যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার ৯৬ গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বাজেকুলটিয়ায় চৈত্র সংক্রান্তী উপলক্ষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লোকজ ঐতিহ্য অষ্টক গান অনুষ্ঠিত হয়।
আজ সোমবার (১৫ ই এপ্রিল) রাত সাড়ে দশটায় বাজেকুলটিয়া মাঠে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার ভুল পোতা অষ্টক যাত্রা দলের শিল্পীরা “মনের মন্দিরে” পালা পরিবেশ করেন।
দেশাত্মবোধক গান “এই তো আমার দেশ,সোনার বাংলাদেশ”- গান পরিবেশনা মধ্য দিয়ে যাত্রা পালা শুরু করা হয়।
উল্লেখ্য ঋতু পরিক্রমায় বসন্তের শেষে ও গ্রীষ্মের পূর্ব-ভাগে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রামীন জনপদের অন্যতম প্রধান লোকজ-উৎসব “চৈত্র-সংক্রান্তী”। এসময়ই মূলতঃ বাংলার লোকজ উৎসবের অন্যতম প্রধান ধারা “গাজন”-এর শাখা “নীল বা শিবের গাজন” অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষতঃ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জমে উঠে এক-ধরনের লোকজ মেলার যা চৈত্রের শেষ-তিন দিন বিভিন্ন ধরনের নাচ-গান ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালনের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। আর এ-সময় এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ তাদের চলমান ঐতিহ্য অনুসারে পরিবেশন করে থাকে অষ্টক গান ।
বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের পূর্বাংশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম একটি প্রধান উপাদান হলো এই অষ্টক গানের সাথে নৃত্যের পরিবেশনা।যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তার প্রেয়সী শ্রীরাধিকা দেবীর প্রণয়-লীলার পটভূমিতে রচিত। এটি এ-অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্যতম প্রধান লোকজ উৎসব “চৈত্র-সংক্রান্তী”-এর সাথেই মূলতঃ সম্পর্কিত তবে এটি শিবের স্থলে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-লীলা বিষয়ক আখ্যান ও লোকপুরাণ অবলম্বনে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এর পরিবেশনাতে গ্রামের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধিকা দেবী ও রাধার সখী গোপীদের সাজ সেজে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গান ও নাচ সহযোগে সাধারণতঃ রাধা-কৃষ্ণের “নৌকা-বিলাস” পালা অভিনয় করে থাকে।
“চৈত্র-সংক্রান্তী” উৎসবের কয়েকদিন পূর্ব হতে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির সামনে একদল শিল্পী গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আয়োজনের লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহ করে। যেখানে বিভিন্ন ধরণের গীত-নৃত্যের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অষ্টক গানের পরিবেশনা দেখতে পাওয়া যায় । আর এক্ষেত্রে বিষয়-বস্তু হিসাবে থাকে শিব, রাধা-কৃষ্ণ, নিমাই সন্ন্যাসী, গৌরী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, চন্ডিদাস-রজকিনী, বেহুলা-লখিন্দর এই অষ্ট-প্রসঙ্গ।আর তাই বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অষ্ট সখীসহযোগে গান লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঘরানা হলো অষ্টকগান।
অষ্টক গান পরিবেশনার দুটি ধরণ রয়েছে-১. পাট ( শিবের প্রতীকী রূপ যা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়) নাচানির সময় পালা গানের সহায়ক হিসেবে; যেখানে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা রাধা-কৃষ্ণ এবং সখি সেজে প্রেমের গান গায় এবং ২. “চৈত্র-সংক্রান্তি”-এর দিন রাত্রে যাত্রা-পালার মাধ্যমে; যেখানে অভিনয়ের মাধ্যমে সংলাপ ও গানে কৃষ্ণ ও রাধার প্রেম-লীলার আখ্যান পরিবেশিত হয়।
অষ্টক গানের ভাষা আটপৌরে ও অতি সাধারণ আঞ্চলিক ভাষা সমৃদ্ধ হলেও এর আবেগ ও ভাবের প্রকাশ খুবই হৃদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর। এই গান সাধারণতঃ খেয়ালের ঢঙে গাওয়া হয় এবং গানে স্থায়ী ও অন্তরা নামক দুটি স্তবক থাকে। যাতে অন্তরাগুলি ভগ্ন ত্রিপদীর আঙ্গিকে রচিত। শিব ও অন্যান্য অবতারদের সম্পর্কে গাওয়া গানগুলোতে হালকা রসের মাধ্যমে শিব-পার্বতীর দাম্পত্য জীবনের দ্বন্দ্ব ও ভালাবাসার প্রকাশ এবং সংশ্লিষ্ট অবতারের মহিমা ও যাপিত জীবনালেখ্য দেখানে হয়। আর কৃষ্ণ-রাধার সম্পর্কিত গানগুলোতে অনুরাগ-অভিমানের প্রাধান্য থাকে। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের গ্রামেগুলোর পার্শ্বেই রয়েছে নদী আর তার নিকটে বা পারাপারে দেখা যায় খোলা মাঠ যেখানে দৈনন্দিন বাজার বা হাট বসে, আর এসব বাজার বা হাটে কিংবা পাশ্ববর্তী গ্রামে নদী পারাপারের মাধ্যমেই যেতে হয়ে; অষ্টক গীতি-নৃত্যে নদী পারাপারের এই চিরন্তন দৃশ্যই কৃষ্ণ-রাধা প্রণয়-আখ্যানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় যা “রাধা-কৃষ্ণের নৌকা বিলাস পালা” নামে পরিচিত।
৮ থেকে ১০ জন শিল্পী নিয়ে অষ্টক গানের দল গঠিত হয়। তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গান ও নাচ পরিবেশন করে থাকেন। এতে একজন প্রধান গায়েন (যিনি সূত্রধর বা “সরকার” নামে পরিচিত), একজন করে কৃষ্ণরূপী বালক ও রাধারূপী বালক (ক্ষেত্র বিশেষে বালিকা) থাকেন।এ ছাড়াও একজন পরিচালক / পরিবেশক এবং আরও তিন বা ততোধিক পরিবেশনকারী থাকেন। সূত্রধর বা “সরকার” গানের শুরু ও গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তার নির্দেশ অনুসারেই অন্যান্য কুশীলবরা রীতিনীতি ও প্রয়োজনীয় তাল-লয় ও ধাপ-সমূহ রক্ষা করে পরিবেশনা সচল রাখেন।আর এতে কখনো জোরালো ও চটুল – আবার কখনো ধীর লয়ে গাইতে থাকা গানের মধ্যে মধ্যে চলতে থাকে নৃত্যের প্রদর্শন।
অষ্টক গান পরিবেশনের অনুষাঙ্গিকরূপে বাঁশি, ঢোল, হারমোনিয়াম, মন্দিরা ও খোল বা মৃদঙ্গ, করতাল, ঘুঙুর ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এই সব বাদ্যযন্ত্রীদেরকে বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়, যেমনঃ খুলি, হারমোনিয়াম মাস্টার ইত্যাদি।
অষ্টক গানের সূচনার পূর্বে উঠান বা মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাদ্যযন্ত্রীরা প্রথমে জনপ্রিয় কোনো-একটি দেশাত্মবোধক গানের সুরে সম্মিলিত বাদ্য বাজান এবং এর সঙ্গে সঙ্গে উঠানের একপাশ থেকে কৃষ্ণ, রাধা ও তার অষ্ট সখী দুই বাহু তুলে বাদ্যের তালে তালে নাচতে নাচতে বাদ্যযন্ত্রীদের সামনের অভিনয়স্থলে এসে বৃত্তাকারে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করেন। এরপর বাজনা শেষে কৃষ্ণ এবং রাধাসহ সখীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বন্দনা পর্বের সূচনা করেন।এক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ-রূপী অভিনেতার মুখোমুখি শ্রীরাধিকা ও সখী-রূপী অভিনেতারা জোড়হাতে বসে বন্দনার সূচনা করেন এবং বন্দনার একটি অন্তরা শেষে তারা বসা অবস্থা থেকে জোড়হাতে দেহের উপরের অংশ ঘোরাতে ঘোরাতে উঠে দাঁড়ান, কিন্তু পরবর্তী অন্তরা শুরুর আগেই বসে যান ও নতুন অন্তরা শুরু করেন। বন্দনায় সাধারণতঃ দেবী সরস্বতী স্তুতি করা হলেও কখনো কখনো পিতা-মাতা, শিক্ষাগুরু প্রমুখেরও স্তুতি করা হয়। বন্দনার পর শুরু হয় মূল পালা যেখানে “সরকার”, যিনি কৃষ্ণ চরিত্রেও অভিনয় করেন, বর্ণনা করেন এবং এর প্রত্যুত্তোরে থাকে রাধার কথকতা। অষ্টক গীত- নৃত্যের পরিবেশনায় বর্ণনার সময় অভিনেতারা অভিনয় শৈলী এবং গীতের সঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করে থাকেন।
অষ্টক গানের শিল্পী ও বাদ্যকরেরা সবক্ষেত্রেই দাঁড়িয়ে থেকেই পরিবেশনা প্রদর্শন করে থাকেন। রাত্রিকালীন অষ্টক গান পরিবেশনার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে মঞ্চ ব্যবহার করা হয় যার সুনির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। সাধারণ যাত্রা-পালার মঞ্চেই এটি পরিবেশিত হয়। আর দিনের বেলায় পরিবেশনার ক্ষেত্রে কুশীলররা বাড়ীর উঠানে তাদের সুবিধামতো স্থানে অবস্থান নিয়ে অষ্টক গীত-নৃত্যের পরিবেশনা করেন এবং দর্শকগণ উঠানের চারিপার্শ্বে ও ঘরের বারান্দায় বসে বা দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করেন।
অষ্টক গানের পরিবেশনার সাথে যুক্ত শিল্পীরা সাজসজ্জায় বিভিন্ন ধরণের রং ও প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন।যেমনঃ স্নো, পাউডার, কাজল, আলতা, কিছু রাসায়নিক দ্রব্য প্রভৃতি। এসব কুশীলবদের পোষাক সব-সময় বর্ণিল ধরণের হয়ে থাকে, যেমনঃ কৃষ্ণ চরিত্রে রূপদানকারী শিল্পী জরির কাজ করা আঁটসাঁট একটি কটি-বস্ত্র ও ধুতি পরে, আবার রাধা ও তার সখী চরিত্রে রূপদানকারীরা উজ্জ্বল রংয়ের শাড়ি পরিধান করেন। আর পরিবেশনার সাথে যুক্ত অন্যান্য কুশীলবরা সাধারণতঃ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার্য পোষাকই পরিধান করেন। এই সাজ-সজ্জা সাধারণতঃ বাড়ীর উঠানের এক কোণে ঘেরা-টোপ দিয়ে তৈরী আচ্ছাদনস্থলে গ্রহণ করেন।
অষ্টক গান সাধারণতঃ নিম্নবর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী যেমনঃ দাস, নমঃশুদ্র, ঘরামি, জেলে, জোলা,কামার-কুমার ও রাজবংশীরা পালন ও উপভোগ করে থাকে। যেহেতু এটি সাধারণতঃ বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে পরিবেশন করা হয় তাই এখানে গ্রামের গৃহবধু থেকে শুরু করে তার কোলের শিশুটি পর্যন্ত সকলেই দর্শক-শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকেন।
দেশ বিভাগের পর সনাতন ধর্মীদের একটি বড় অংশ ওপার বাংলায় চলে যাওয়ায় তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত লোকজ উৎসবগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। অষ্টক গান বর্তমানে ওপার বাংলার মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ জেলার অন্যতম প্রধান লোকজ উৎসব হলেও আমাদের দেশের কেবলমাত্র নিম্নবর্ণের সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চলেই এর প্রচার ও প্রসার লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে এদেশের বৃহত্তর খুলনা, যশোর, নড়াইল,কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অষ্টক গানের প্রচলন রয়েছে।
অষ্টক গান এদেশের অস্তায়মান লোকজ উৎসবের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। অতীতের পরিবেশক কয়েকজন প্রখ্যাত শিল্পী থাকলেও বর্তমানে এদের প্রচার ও প্রসার বলতে গেলে প্রায় শূণ্যের কৌঠায়। বাংলাদেশে অষ্টক গানের স্বনাম-ধন্য কিছু শিল্পীর মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার বালিয়াঘাট গ্রামের স্বরূপ চন্দ্র বিশ্বাস, নিরাপদ বিশ্বাস এবং বিষ্ণুপদ মণ্ডল; নড়াইলের বাহিরডাঙা গ্রামের স্বভাবকবি বিপিন সরকার, ভাদুলিডাঙা গ্রামের সুবোধ বিশ্বাস অন্যতম। বর্তমানে যেসব দলের নাম আলোচিত হয়ে থাকে তাদের মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপার রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস-এর, নড়াইল জেলার ভাদুলিডাঙা গ্রামের সুবোধ বিশ্বাস-এর, কুষ্টিয়া জেলার মিরপুরের হোসেন আলী-এর, নড়াইল জেলার হাতিয়ারার নিখিল গোস্বামী-এর এবং বাহিরডাঙা গ্রামের বিপিন সরকার-এর অষ্টক গানের দল।
সাধারণত চৈত্র মাসের শেষ দিকে চৈত্র সংক্রান্তিকে সামনে রেখে গ্রামে-গ্রামে,হাটে-বাজারে এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। তবে দিন দিন কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ অষ্টক গান।