হুমায়ুন কবির কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ :ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পিতা মোশারফ হোসেন এবং গৃহিণী মা সোনালী বেগম দম্পতির একমাত্র কন্যা মাহমুদা নাসরিন লিমা। তিনি উপজেলার চাপরাইল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঝিনাইদহ জেলার নুরুননাহার মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০০৬ সালে ঢাকা বাংলা কলেজে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরের বছরই তার বাবা মা আর পাঁচটা মেয়ের মতো ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতী এলাকার বাসিন্দা ঢাকার একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করা এ.কে. আজাদের সাথে তার বিয়ে দেন। একদিকে লেখাপড়া আর একদিকে সংসার তার ভিতর মনের মধ্যে লুকায়িত নিজে কিছু করার স্বপ্নটা সবসময় তাকে তাড়িত করতো। সংসার সামলিয়ে পরের অধীনে চাকরি করাটা কঠিন হবে ভেবে লিমা মনে মনে স্থির করলেন ব্যবসা করবেন। ২০০৯ সালে প্রথম তৈরি পোশাক বিক্রির মধ্য দিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করলেন তিনি । শুরুতে তিনি বাকিতে পণ্য কিনে তা সীমিত লাভে বিক্রি করতেন। ২০১০ সালে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করেন স্বপ্নবাজ এই নারী ।এসময় সংসার ও ছোট্ট ছেলেকে সামলিয়ে ব্যবসাটা চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন ছিল তার জন্য। তবুও তিনি থেমে যাননি। নিজের কাছে টাকা না থাকায় স্বামীর কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ব্যবসাটা আরেকটু বড় করার চেষ্টাও করেন। বর্তমান গ্লোবালাইজেশনের যুগে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ায় লিমার মাথায় আসলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পেজ খুলে ব্যবসা করার ধারণা। ২০১৫ সালে প্রথম “লিমাস বুটিক” নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন লিমা। নিজ গ্রামের মহিলাদের হাতের তৈরি নিজস্ব ডিজাইনের মেয়েদের থ্রি পিস, ওয়ান পিস, ওড়না, হাতের কাজ করা শাড়ি, ব্লাউজ, বেড সিট তার পেজ থেকে লাইভে এসে প্রদর্শনী শুরু করেন। ওই লাইভ সম্প্রচার সরাসরি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের তিনি নিজের পণ্যের ব্যাপারে আকৃষ্ট করেন নিজ পণ্যের গুণাগুণ শৈল্পিক উপস্থাপনার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে ভালো সাড়াও পান ফলোয়ারদের কাছ থেকে। ক্রেতারা তার লাইভ দেখে নিজের পছন্দমত পোশাকটি অর্ডার করেন। প্রতি লাইভে অর্ডার করা পণ্য কুরিয়ার এর মাধ্যমে পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে গ্রাহকের নিকট ক্যাশঅন ডেলিভারিতে পৌছানোর যাবতীয় কাজও লিমা নিজে হাতে করেন। লিমাস বুটিকের তৈরী পণ্যের গুণগত মানের কারণে এই পেজের ফলোয়ারদের নিকট অন্যরম এক আস্থার জায়গা করে নিতে সক্ষমও হয়েছেন লিমা।এই পেজ এ ৬ শত থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকার পোশাক পাওয়া যায় এবং ক্রেতারা তা নিয়মিত কিনছেন। বর্তমানে তার এই পেজটির ফলোয়ার সংখ্যা ৩ লাখের অধিক। ধীরে ধীরে তিনি অনলাইন এই পেজটাকে নিজের ব্যবসার অন্যতম প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অটুট মনোবল ও দক্ষতা দিয়ে দুই সন্তানের জননী লিমা স্বামীর সংসার সামলিয়ে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে সফলতার সাথে কাজ করে নিজেকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি নিজেই তার সকল পণ্যের মডেল। বিভিন্ন পোশাকে নিজের ছবি মডেল হিসেবে তুলে তিনি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন ফেসবুক বা পেজে এ আপলোড দিয়ে । ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নে নিজের গ্রামের বাড়ির অনেক নারীসহ আশপাশের ষাটবাড়িয়া, মনোহরপুর,পুকুরিয়া, মোস্তবাপুর, ভাটাডাঙ্গা, চাপরাইলসহ অনেক গ্রামের নারীরা লিমাস বুটিকের নিজস্ব ডিজাইনের পোশাকে হাতের কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন, একই সাথে ঘটিয়েছেন তাদের নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নও। তেমনি লিমাস বুটিকের একজন নারী কর্মী হলেন হাফিজা বেগম। কথা হলো তার সাথে, তিনি বললেন, অনেকদিন ধরে লিমা আপার সাথে কাজ করছি। ঘর সংসারের কাজ সেরে অবসরে লিমাস বুটিকের তৈরি পোশাকের উপর হাতের কাজ করে ভালো আয়ও করছি। ফলে অর্থনৈতিকভাবে আজ আমি স্বাবলম্বী। লিমা ঢাকার উত্তরা এলাকার নিজের বাসার একটি আলাদা কক্ষে লিমাস বুটিকের অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রধানত সব কাজ লিমা নিজে হাতে করতেই পছন্দ করেন। পণ্য তৈরি দেখভাল ও গ্রাম থেকে ঢাকা পাঠানোর ব্যাপারে তার মা-বাবা তাকে সহযোগিতা করে থাকেন। এভাবেই অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে সফল উদ্যোক্তা লিমা ঘরে বসে লাখ টাকার অধিক আয় করছেন প্রতি মাসে । সফল নারী উদ্যোক্তা মাহমুদা নাসরিন লিমার সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি জানান, মূলত হস্তশিল্পের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই তিনি তৈরি পোশাকে হস্তশিল্পের নানা কারুকার্যসমৃদ্ধ পণ্য তৈরী ও বিক্রির ব্যাবসাটি বেছে নিয়েছেন।পরিবার আমার এই কাজে প্রচুর উৎসাহ দেয় ও সাহস যোগায়। বিশেষ করে আমার মা-বাবা ও স্বামী আমাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে থাকেন। ভবিষ্যতে ঢাকা শহরে বড় ধরনের একটি লিমাস বুটিকের আউটলেট দেওয়ার স্বপ্ন রয়েছে আমার।
কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোসাম্মৎ তাসলিমা বেগম বলেন,কালীগঞ্জের মেয়ে মাহমুদা নাসরিন লিমা শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে একারণে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই। সফল এই নারী উদ্যোক্তা যদি উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত ” জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমে আবেদন করেন তাহলে আমরা উনার কর্মকাণ্ড যাচাই-বাছাইপূর্বক উনাকে সম্মানিত করতে পারবো। উদ্যোগী এই নারীর জন্য শুভকামনা রইল।