Sunday, July 27, 2025

যশোরে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আর্বিভাব উৎসব ও বারুনী স্নান অনুষ্ঠিত

Date:

Share post:

স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুর নগর,বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ,খুলনা,বরিশাল, যশোরসহ সারাদেশে মতুয়া অনুসারীদের ধর্মগুরু পূর্ণাবতার শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১৪ তম আর্বিভাব উৎসব ও বারুনী স্নান অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
তারই ধারাবাহিকতায় আজ যশোরের মনিরামপুর -অভয়নগর-কেশবপুর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ৯৬ গ্রামের হেলারঘাট মহাশ্মশানে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আর্বিভাব উৎসব ও বারুনী স্নান অনুষ্ঠিত হয়।
পূর্ণলাভের আশায় দলেদলে শিশু কিশোর-কিশোরী,নারীপুরুষ আবালবৃদ্ধবনিতা ঐতিহ্যবাহী মুক্তেশ্বরী নদীতে স্নান করেন এবং পূজার্চনা দেন এবং বিকালে অনুষ্ঠিত হবে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
উল্লেখ্য,মোগল শাসনামলের পূর্ব থেকে শুরু করে তৎপূরবর্তী বৃটিশদের শাসকদের শাসনকালের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমিপুত্রেরা ছিল নিম্ন বর্ণের অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত।সমাজের চোখে এই অস্পৃশ্য শ্রেণীর মানুষের জীবনে ছিল মোগল শাসকদের শাসন – শোষণ,লুটপাট ধর্ষণের বিভৎস্য যন্ত্রণা এবং মোগল শাসনের অবসানের পরে বৃটিশ শাসকদের অপশাসন ও নিয়মবহির্ভূত করের বোঝা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের শুধু অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বরং অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়। একদিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো যন্ত্রের রক্তচক্ষু অন্যদিকে ছিল স্বধর্মীয় উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবহেলা এবং মানসিক অত্যাচার। এই চর্তুমুখী অত্যাচার ও অনাচারে নিম্নবর্গের হিন্দুদের স্বাভাবিক জীবন হয়ে পড়েছিল সংকটাপন্ন।
ঠিক এই রকম একটি কঠিন সংকটময় মুহূর্তেই ১৮১২ সালের ১১ইমার্চ তারিখে বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত সাফলাডাঙ্গা গ্রামে অবতীর্ণ হন পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর । তার মাতা-পিতার নাম অন্নপূর্ণা বৈরাগী ও যশোমন্ত বৈরাগী।
বৈষ্ণব বাড়িতে জন্ম হওয়ার কারণে শাস্ত্র আলোচনার মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাস্ত্রের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করার সুযোগে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।তার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেভাবে না হলেও অভিজ্ঞতালব্ধকে জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন। আর তাই বাল্যকাল থেকেই তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাল্যবন্ধু বিশ্বনাথের জীবন রক্ষা, অন্ধ–কে আলো দান সহ বিভিন্ন মরণব্যধি দূর করার ক্ষেত্রে তার অসীম ক্ষমতার কথা দিকে দিকে আলোচিত হতে থাকে। তার সঙ্গে শুধুমাত্র নিম্নবর্ণের মানুষের সক্ষতা গড়ে ওঠে তা নয়; ব্রাহ্মণ সন্তানেরাও তাঁর সংস্পর্শে আসেন। ধর্মীয় অবহেলা, জাতিবিদ্বেষ, সামাজিক বৈষম্যসহ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হওয়া নমঃশূদ্র জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর মন্দির গড়ে তোলার জন্যেই শুধু উদ্বুদ্ধ করতেন না বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্ধুদ্ধ করতেন এবং তিনি নিজ হাতেও গড়ে তোলেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি স্বতন্ত্র ধারার সম্পূর্ণ আধুনিক ধর্মমত ও রীতিনীতি প্রচলন করেন যা মতুয়া ধর্ম নামে পরিচিত। তার প্রবর্তিত এই নতুন ধর্মদর্শন অত্যন্ত আধুনিক এবং কুসংস্কার মুক্ত যা মূল হিন্দু ধর্মীয় আচরণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ আলাদা।
আর এই স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তক শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তার জন্মস্থান ওড়াকান্দিতে স্নানোৎসব ও বারুণী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১৪তম আবির্ভাবোৎসব ও বারুনীমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
হিন্দু ধর্মের মত অনুসারে বরুণের কন্যা বারুণী। বরুণের পূজা বা গঙ্গাপূজা-সংক্রান্ত উৎসবকে বারুণী পুজা বা বারুণী উৎসব বলে। প্রতি বছর চৈত্র মাসের বারুণী তিথিতে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেই অনুসারে এ বছর ৬ই এপ্রিল বারুণী পূজা হবে। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বারুণী পুজা হবে ৬ই এপ্রিল শনিবার , ২৩শে চৈত্র ১৪৩০।
স্কন্দ পুরাণ অনুসারে চৈত্রমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে শতভিষা নক্ষত্র যোগ হলে সেই তিথি বারুণী নামে পরিচিত। এই তিথিতে স্নান করলে বহুশত সূর্যগ্রহনের জন্য গঙ্গাস্নানের যে ফল সেই ফল লাভ করা যায়। হিমালয় কন্যা গঙ্গার অপর নাম হল বারুণী। বারুণী স্নান বলতে এখানে গঙ্গা স্নানেরই প্রতিরূপ।বাংলা সনের প্রতি চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে এই স্নান অনুষ্ঠিত হয়। শাস্ত্র মতে কোন বছর যদি ঐদিনটি শনিবার হয় তবে ঐ বারুণী স্নান অসাধারণত্ব লাভ করে মহা বারুণী স্নান রুপ লাভ করে।এই স্নানটি বস্তুতঃ হিন্দু ধর্মীয় একটি পূণ্যস্নান উৎসব।
পূর্ণস্নান গতকাল বুধবার (২৬ শে মার্চ) রাত থেকে শুরু হয়ে আজ বৃহস্পতিবার (২৭ শে মার্চ) রাত পর্যন্ত চলবে।
পাপ থেকে মুক্তি ও পুণ্য লাভের আশায় পুণ্যার্থীরা অংশ নেবেন এই স্নান উৎসবে।
দক্ষিণের জনপদ কপিলমুনিতে ঠিক কবে থেকে বারুণী মেলার আয়োজন হয়ে আসছে তা হিসাব করা খুব কঠিন।জনশ্রুতি পুন্যাত্মা কপিল কালের কোন এক সময় সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য কপোতাক্ষের পাড়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির স্থাপন করেন এবং তিনি সেখানে ধ্যান মগ্ন অবস্থায় আদ্যা শক্তির সাক্ষাত পান। গভীর ধ্যানের দ্বারা তিনি সেখানে গঙ্গাকে কপোতাক্ষের সঙ্গমে একত্রিত করেন।সময়টি ছিল চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী।আর এখানেই স্থাপন করেছিলেন বারুণী স্নানঘাট।
জীব জগতের বিভিন্ন কঠিন পথ চলতে গিয়ে কলির মানুষের জীবন বিভিন্ন পাপাচারে পূর্ণ হয়ে যায় আর তাই সকল পাপের কালিমা মুক্ত হওয়ার জন্য পূণ্য স্নান করা হয়। কথিত আছে যে এ তিথিতে গঙ্গা স্নান করে এক মনে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ঈশ্বর সব পাপ ক্ষমা করে দেন এবং ঈশ্বরের অপার কৃপা লাভ করা যায়।এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ঠাকুরবাড়িসহ বিভিন্ন প্রদেশে বারুনীস্নান অনুষ্ঠিত হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

চার-পাঁচ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা মোস্তফা জামাল

অনলাইন ডেস্কঃ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন বলে...

ভোজগাতিতে একই পরিবারের তিনজন গু’রুতর আ”হত নারীকে শ্লী’লতাহা’নির অ’ভিযোগ

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ভোজগাতি গ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় একই পরিবারের তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের...

ডায়মন্ড হারবার জেলা পুলিশের উদ্যেগে র’ক্তদান কর্মসূচি মগরাহাট থানাতে

কলকাতা থেকে নিউজ দাতা মনোয়ার ইমাম: আজ বৈকালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মগরাহাট থানার উদ্যোগে একটি রক্তদান কর্মসূচি পালন...

যশোরে রামনগর ইউনিয়ন পরিষদে স্ব’ল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য বিতরণ

ওয়াজেদ আলী,স্টাফ রিপোর্টার: যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়ন পরিষদে স্বল্পমূল্যের কার্ডধারীদের মাঝে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর পণ্যসামগ্রী...