
স্বীকৃতি বিশ্বাস,যশোর:
দেবী কালী হলেন হিন্দুধর্মের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দেবী।
দেবী কালী বা কালিকা হলেন হিন্দুধর্মে আদিপরাশক্তি বা মহাদেবী পার্বতীর একটি রূপ। তিনি শুধু একজন দেবী নন, তিনি হলেন মহাকাল অর্থাৎ সময়ের নিয়ন্ত্রক।তন্ত্র অনুসারে, কালী হলেন দশমহাবিদ্যার (দশটি প্রধান তান্ত্রিক দেবী) প্রথম দেবী। তাঁকে সময়, পরিবর্তন, সৃষ্টি, মৃত্যু ও ধ্বংসের দেবী মনে করা হয়।
“কাল” শব্দের অর্থ সময়, এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুও। দেবী কালী এই সময়ের ঊর্ধ্বে এবং সমস্ত কালের নিয়ন্তা। তাঁর গাত্রবর্ণ সাধারণত ঘন কালো বা নীল, যা কাল (সময়) বা অন্ধকারের প্রতীক।তিনি ভয়াল এবং ভয়ঙ্করী রূপ ধারণ করেন। তাঁর লোলজিহ্বা (বের করা জিভ), নরমুণ্ডের মালা (মানুষের মাথার খুলির মালা), চতুর্ভুজা (চার হাত) এবং উন্মুক্ত চুল—এই রূপ সৃষ্টির স্থূল এবং সূক্ষ্ম উভয় ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতীক।
দেবী কালীর চিত্রে সাধারণত তাঁকে তাঁর স্বামী সদাশিবের (মহাকাল) বুকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এটি এই তত্ত্বের প্রতীক যে, শিব (পুরুষ বা নির্গুণ ব্রহ্ম) নিষ্ক্রিয় হলে শক্তি (কালী বা প্রকৃতি) তার ধ্বংসাত্মক কার্য সম্পন্ন করতে পারে না। শিব সত্য বা বাস্তব এবং কালী সেই সত্যের শক্তি বা প্রকাশ।
কালী শুধু একটি দেবী রূপ নন, তিনি হিন্দু শাক্ত সম্প্রদায়ের মতে পরমব্রহ্মের শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। শাক্ত সম্প্রদায় কালীকে আদিপরাশক্তি বা আদ্যাশক্তি বা মহাদেবী রূপে পূজা করে, যিনি হলেন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ দেবী।এই মত অনুসারে, সমস্ত হিন্দু দেবদেবী (বিষ্ণু, শিব সহ) এই মহাদেবীরই বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র।দেবীভাগবত, কালিকা পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্র অনুসারে, কালী হলেন পরমব্রহ্মের সত্য স্বরূপ পূর্ণপ্রকাশমূর্তি।
তিনি সগুণ, নির্গুণ এবং গুণাতীতা—একই সঙ্গে সমস্ত গুণের অতীত এবং গুণের ধারক।তিনিই শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ এবং সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের জনয়িত্রী (সৃষ্টিকর্ত্রী), পালয়িত্রী (রক্ষাকারী) ও কলয়িত্রী (ধ্বংসকারী)।
শাক্ত মতে, দেবী কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। তিনি যখন নিজের দেহকোষ থেকে আবির্ভূতা হন, তখন তাঁর কৃষ্ণবর্ণ রূপের কারণেই তাঁকে কালী বলা হয়। সৃষ্টির শুরুতে মধু ও কৈটভ নামক দুই দৈত্য ব্রহ্মাকে আক্রমণ করলে, ব্রহ্মা আদ্যাশক্তির স্তব করেন। তখন আদ্যাশক্তি মহামায়া থেকেই কালীর আবির্ভাব হয়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই দৈত্যের অত্যাচারে দেবতারা ভয় পেলে, তাঁরা আদ্যাশক্তির আরাধনা করেন। তখন আদ্যাশক্তির দেহকোষ থেকে অম্বিকা আবির্ভূতা হন, যিনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হওয়ায় তাঁর অপর নাম হয় কালী।
সুতরাং, কালী হলেন সেই আদ্যাশক্তি, যিনি সময় ও সৃষ্টির ঊর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও, সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের জন্য বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হন। ভক্তের কাছে তিনি যেমন সংহারকারিণী, তেমনই তিনি করুণাময়ী ও অভয়দায়িনী।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে পালিত হয়। দুর্গাপূজার পর এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। ২০২৫ সালের শ্যামাপূজা বা কালীপূজা ২০শে৮ অক্টোবর, সোমবার। অমাবস্যা তিথিতে গভীর রাতে বা মধ্যরাত্রে দেবী কালীর পূজা করা হয়। এটি তান্ত্রিক বা অতান্ত্রিক উভয় পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। মধ্যরাত্রে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়। অনেক মণ্ডপে ছাগ, মেষ বা মহিষ বলির প্রথাও প্রচলিত আছে। এই একই দিনে সারা দেশে শুভ দীপাবলি বা দিওয়ালি উৎসবও পালিত হয়।
শ্যামাপূজা মূলত শক্তির পূজা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী শ্যামা বা কালী হলেন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের মাধ্যমে ভক্তের জীবনে কল্যাণ আনয়নকারী। তিনি অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির বিজয় নিশ্চিত করেন। শান্তি, সংহতি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে তাকে দেখা হয়।
সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়।দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপূজা করা হয়।
কালীপূজার দিনে সন্ধ্যায় মন্দির, মণ্ডপ ও হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষ প্রদীপ ও মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। এই আলোকের উৎসবকে দীপাবলি বলে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে স্বর্গীয় মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের স্মরণ করেন।
পূজা বিভিন্ন মন্দির, মণ্ডপ, বাসা-বাড়ি, দোকান এবং মহাশ্মশানেও (শ্মশান কালীপূজা) অনুষ্ঠিত হয়।
পূজা ছাড়াও প্রসাদ বিতরণ, আরতি, ধর্মীয় সংগীত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আলোকসজ্জা ইত্যাদি কর্মসূচি থাকে।