স্বীকৃতি বিশ্বাসঃ
বিজয় দশমী হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু উৎসব, যা প্রতি বছর দুর্গাপূজা বা নবরাত্রির শেষে অনুষ্ঠিত হয়।'বিজয়' (অর্থাৎ জয়) এবং 'দশমী' (অর্থাৎ দশম দিন) এই দুটি শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। এই দিনটি মূলত অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির জয়-এর প্রতীক। দেবী দুর্গার কৈলাসে প্রত্যাবর্তনের প্রতীক।
২০২৫ সালে (বাংলা ১৪৩২ সাল) বিজয় দশমী পালিত হবে বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে।
শাস্ত্রীয় পঞ্জিকা অনুসারে, ২০২৫ সালে (১৪৩২ বঙ্গাব্দ) দেবী দুর্গা গজে (হাতি) চড়ে মর্ত্যে আগমন করেন। শাস্ত্রমতে, গজে আগমন অত্যন্ত শুভ বলে বিবেচিত। এর অর্থ হল, বসুন্ধরা হবে শস্য-শ্যামলা। দেশজুড়ে সুখ-শান্তি বৃদ্ধি পাবে, সুষম বৃষ্টিপাত হবে এবং কৃষি ফলন ভালো হবে এবং দেবী দুর্গা দোলায় (পালকি) চড়ে কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন। দোলায় গমনকে সাধারণত অশুভ বলে মনে করা হয়। এর ফল হলো— 'দোলায়াং মকরং ভবেৎ' অর্থাৎ, পৃথিবীতে মহামারী বা মড়ক, রোগব্যাধি, ভূমিকম্প বা যুদ্ধ জাতীয় অস্থিরতা ও বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে।
২০২৫ সালে দেবীর আগমন শুভ হলেও, গমন অশুভের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ, বছরের শুরুটা ভালো হলেও, পরবর্তী সময়ে কিছু ভোগান্তি বা অস্থিরতা আসতে পারে।
বিজয় দশমীরতাৎপর্য প্রধানত দুটি পৌরাণিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। পুরাণ অনুসারে, দেবী দুর্গা নয় দিন ও নয় রাত ধরে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের এই দশমী তিথিতে তাকে বধ করে বিজয় লাভ করেন। এই বিজয়কে স্মরণ করেই দিনটিকে 'বিজয়া দশমী' বলা হয়। এটি দুর্গাপূজার শেষ দিন এবং এই দিনেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
এই দিনেই ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরাম লঙ্কার রাজা দশানন রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। ভারতের অনেক অঞ্চলে এই উপলক্ষে 'দশেরা' বা 'দশহরা' উৎসব পালন করা হয় এবং রাবণের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
বিজয় দশমীর প্রধান দুটি অংশ হলো প্রতিমা বিসর্জন এবং বিজয়ার আনুষ্ঠানিকতা।এ দিনে বিবাহিত মহিলারা দেবীকে সিঁদুর, পান ও মিষ্টি দিয়ে বরণ করেন। দেবীকে বিদায় জানানোর আগে মহিলারা দেবীর চরণে সিঁদুর ছুঁইয়ে নিজেরা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। এই সিঁদুর খেলা দাম্পত্য জীবন ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
এরপর দেবীর মাটির প্রতিমা শোভাযাত্রা সহকারে নদী বা নিকটবর্তী জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই বিসর্জন দেবীর মর্ত্যলোক থেকে কৈলাসে (শ্বশুরবাড়ি) ফিরে যাওয়ার প্রতীক। ভক্তরা এই সময় 'আসছে বছর আবার হবে' বলে মাকে বিদায় জানান।
বিসর্জনের পর সবাই একে অপরের বাড়িতে যান। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয় এবং কোলাকুলি ও পদস্পর্শ করে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। এটি সম্পর্ককে মজবুত করার এক সামাজিক রীতি।
বিজয় দশমী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, এর গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। বিজয় দশমী সেই মহাশক্তির জয় এবং অসুর শক্তির বিনাশের প্রতীক। এটি ভক্তদের কাছে ন্যায়ের জয় ও শুভশক্তির শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা বহন করে।
বাঙালি হিন্দুদের কাছে উমা বা দেবী দুর্গার বাপের বাড়ি মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বামীগৃহ কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দিন। এই বিদায়পর্বের মধ্যে আনন্দ ও বিষাদের এক মিশ্র অনুভূতি থাকে।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, এই দিনটি খুবই শুভ বলে বিবেচিত। তাই অনেকে এই দিনে নতুন কাজ, ব্যবসা বা বিদ্যারম্ভের মতো শুভ অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।
দুর্গাপূজা এবং বিজয় দশমী মূলত একটি মিলনোৎসব। এই দিনে সবাই ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের বাড়িতে যায়, কোলাকুলি করে এবং মিষ্টিমুখ করে। এটি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
এটি বাঙালি সংস্কৃতির এক অন্যতম বৃহৎ উৎসব। এই উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একত্রিত করে এবং এর মাধ্যমে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হয়।
সিঁদুর খেলার মাধ্যমে বিবাহিত মহিলারা দেবী এবং একে অপরের প্রতি সৌভাগ্য ও দাম্পত্য সুখের কামনা করেন। বিসর্জনের করুণ সুর এবং 'আসছে বছর আবার হবে'র আশ্বাস ভক্তদের আবেগকে এক অন্য মাত্রা দেয়।
বাঙালি সংস্কৃতিতে, বিজয়া দশমীর দিনে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানো হয় এবং এটি দেবীর কৈলাসে স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তনের দিন। এই দিনে সবাই মিষ্টিমুখ করে এবং বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ও ছোটদের আশীর্বাদ করে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করা হয়।