
স্বীকৃতি বিশ্বাসঃ
মহানবমী হলো নবরাত্রি বা দুর্গাপূজার নবম দিন এবং দুর্গাপূজার অন্যতম প্রধান তিথি। সাধারণত মহানবমীকেই দুর্গাপূজার অন্তিম দিন বা শেষ আরাধনার ক্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়। পরদিন কেবল বিজয়া ও বিসর্জন পর্ব চলে। এই দিনেই ভক্তরা দেবীকে প্রাণ ভরে দেখে নেওয়ার সুযোগ পান।
সাধারণত উদয়া তিথি অনুসারে দুর্গাপূজার দিন গণনা করা হয়। সেই হিসেবে, ১ অক্টোবর, বুধবার হলো মহানবমীর প্রধান পূজার দিন।১ অক্টোবর, বুধবার, দিনের বেলায় (দুপুর ২:৩৬ বা সন্ধ্যা ৭:০১ মিনিটের আগেই) এই পূজা সম্পন্ন করতে হবে
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে টানা আট দিন যুদ্ধ করার পর নবমীর দিন তাকে বধ করেন। তাই এই দিনটি মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবীর অশুভ শক্তির উপর শুভ শক্তির বিজয়কে উদযাপন করে। এই দিনকে বিজয় ও শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
নবরাত্রির শেষ দিনে দেবী দুর্গাকে তাঁর সিদ্ধিদাত্রী রূপে পূজা করা হয়। এই দেবী আট প্রকার সিদ্ধি (দৈবশক্তি বা অলৌকিক ক্ষমতা) প্রদান করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
আট প্রকার সিদ্ধিকে অষ্টসিদ্ধি বলা হয়। দেবী দুর্গা তাঁর সিদ্ধিদাত্রী রূপে ভক্তদের এই অলৌকিক শক্তি বা ক্ষমতাগুলি প্রদান করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
এই আট প্রকার সিদ্ধি হলো:
১. অণিমা- এই সিদ্ধির প্রভাবে সাধক বা যোগী নিজের শরীরকে অণুর (ক্ষুদ্রতম কণা) মতো ক্ষুদ্র করে ফেলতে পারেন, যার ফলে তাকে দেখা বা স্পর্শ করা অসম্ভব হয়ে যায়।
২. মহিমা- এই সিদ্ধির মাধ্যমে সাধক নিজের শরীরকে ইচ্ছানুসারে বিশাল বা বৃহৎ করে তুলতে পারেন।
৩. গরিমা-এর প্রভাবে সাধক নিজের শরীরকে ইচ্ছানুসারে ভারী বা গুরু করে ফেলতে পারেন, যা ধারণ করা বা নড়ানো অন্যের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
৪. লঘিমা- এর মাধ্যমে সাধক নিজের শরীরকে ইচ্ছানুসারে হালকা বা লঘু করে তুলতে পারেন, এমনকি বায়ুতেও ভেসে থাকতে সক্ষম হন।
৫. প্রাপ্তি-এই সিদ্ধি লাভ করলে সাধক যে কোনো কিছু প্রাপ্ত করতে পারেন। তিনি দূরে থাকা কোনো বস্তুকে স্পর্শ করতে পারেন বা যে কোনো স্থানে গমন করতে পারেন, এমনকি দেবতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
৬. প্রাকাম্য-এর প্রভাবে সাধক যা ইচ্ছা করেন তাই পূরণ করতে সক্ষম হন। জলের নিচেও শ্বাস নেওয়া বা দীর্ঘকাল ধরে জলে ডুবে থাকা ইত্যাদি ক্ষমতা লাভ করেন।
৭. ঈশিত্ব-এই সিদ্ধির বলে সাধক ঈশ্বরের মতো ক্ষমতা লাভ করেন এবং সকল বস্তুর উপর আধিপত্য বা নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন।
৮. বশিত্ব-এর প্রভাবে সাধক সকল প্রাণীকে বশীভূত করতে পারেন এবং পাঁচটি মৌলিক উপাদান (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)-এর উপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
এই অষ্টসিদ্ধিগুলিকে আধ্যাত্মিক উন্নতির সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে গণ্য করা হয়, যা কেবল কঠোর তপস্যা ও ভক্তির মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব।
ভক্তরা আন্তরিক চিত্তে তাঁর পূজা করলে সাফল্য, জ্ঞান, শক্তি ও সম্পদ লাভ করেন।
নবমী হোম ও বলিদান: মহানবমীর দিন নবমী হোম বা যজ্ঞ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। অগ্নিকে প্রতীক করে এই যজ্ঞের মাধ্যমে সব দেবদেবীকে আহুতি দেওয়া হয়। অনেক স্থানে এই দিনে বলিদানের প্রথাও দেখা যায়, যা মূলত মনের ভেতরের কাম, ক্রোধ সহ অন্যান্য রিপু বা পশুভাবকে দমন করে দেবভাব জাগ্রত করার প্রতীক।
রামের রাবণ বধ: আরেকটি পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, এই মহানবমীর পূণ্যতিথিতেই শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দেবীর আরাধনা করেছিলেন এবং এই দিনে রাবণ বধ সুনিশ্চিত হয়।
নবমী তিথিতে শাস্ত্র মেনে যে পূজা করা হয়, তাকে নবমী বিহিত পূজা বলা হয়।
পূজার বিশেষ অনুষঙ্গ: নবমী পূজায় নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের বিশেষ ব্যবহার দেখা যায়। যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়।
ফল লাভ: বিশ্বাস করা হয় যে, নবমীর দিন নিয়ম মেনে দেবীর পূজা করলে মানবকুলে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সম্পদলাভ হয় এবং জীবনের সব সমস্যা দূর হয়।
মহানবমী আসলে আধ্যাত্মিকতা, শক্তি ও ভক্তির এক মেলবন্ধন, যা মানুষের ভেতরের ভালো শক্তিকে জাগিয়ে তোলার এবং অসত্যের ওপর সত্যের জয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।