স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ
ষড়ঋতুর পরিক্রমায় বর্ষার বাদল ধারা আর কদম- কেয়ার সৌন্দর্য্যকে বিদায় জানিয়ে শুরু হয়েছে সৌন্দর্য মন্ডিত শরৎ কাল। সুশোভিত শিউলি, শাপলা, শালুক, পদ্ম, কাশফুল আর শুভ্র সাদা মেঘের ভেলা,শরতের বিমোহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপের মহিমার অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে বার বার ফিরে আসে বাঙালির হাজার বছরের শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। আর এই আগমনীবার্তা শুরু হয় ছন্দে গানে,সূরে,চন্ডীপাঠের মাধ্যমে মহালয়ার মধ্য দিয়ে।
অমাবস্যা তিথি শুরু হবে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ মধ্যরাত ১২টা ১৬ মিনিটে এবং শেষ হবে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ মধ্যরাত ১টা ২৩ মিনিটে। সুতরাং, উদয়া তিথি অনুসারে আজকের দিনটিতে (২১ সেপ্টেম্বর) অমাবস্যা পালিত হবে, যা সর্বপিতৃ অমাবস্যা নামে পরিচিত।
একদিকে পিতৃপক্ষের শেষ দিনে যেমন তর্পণ করা হয় তেমনি দেবীপক্ষের সূচনায় এই মহালয়ার পূর্ণতিথিতে চক্ষুদান করা হয় দুর্গা প্রতিমার। মৃণ্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী। আজ (২১ সেপ্টেম্বর) রবিবার ভোর পাঁচটায় দেবী দূর্গাকে মৃণ্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠার সেই মহেন্দ্রক্ষণ।
পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া।মহালয়া শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয়। কিন্তু মহালয়া শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়স্থল। হিন্দুদের বিশ্বাস এই দিন পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে।
মহালয়া সম্পর্কে অনেকগুলি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে জানা যায়-মহাপ্রলয়ের সময় সমগ্র পৃথিবীকে কারণ-সমুদ্রে রূপান্তরিত করে দেবতা শ্রীবিষ্ণু সমুদ্রে অনন্তনাগের উপরে যোগনিদ্রায় ধ্যানস্থ হন। ঠিক এই সময়েই বিষ্ণুর কানের ময়লা থেকে মধু আর কৈটভ নামের দুটি দৈত্যের জন্ম হয়। তারা বিষ্ণুর নাভিপদ্মে অবস্থানকারী ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগিয়ে তোলেন এবং পাঁচ সহস্র বছর ধরে তিনি ঐ দুটি দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গার বোধন হয়। বোধন মানে জাগরণ। শাস্ত্র অনুসারে বাংলা শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত দক্ষিণায়ন কালে দেবতারা নিদ্রা যান আর উত্তরায়ণের সময় দেবতারা আবার জেগে ওঠেন। পুরাণ মতে, ব্রহ্মার নির্দেশমতে পিতৃপক্ষের অবসানে টানা পনেরো দিন ধরে স্বর্গীয় পিতৃপুরুষেরা মর্ত্যের কাছাকাছি আসেন আর তাই এই সময় তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু অর্পণ করলে তাঁরা তুষ্ট হন। এই মহালয়ার দিনেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান ব্রহ্মার কাছ থেকে। ব্রহ্মার বরেই সেই মহিষাসুর মানুষ ও দেবতাদের কাছে অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল। ফলে তাকে পরাস্ত করার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর একত্রিত হয়ে মহামায়ারূপী যে নারীশক্তি তৈরি করেন তিনি হলেন দেবী দুর্গা। দশ অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে দশভূজা দেবী দুর্গা টানা নয় দিন যুদ্ধ করে মহিষাসুরকে বধ করেন। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনের পরেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা আর তাই হিন্দুদের মধ্যে শুভ শক্তির আরাধনায় মহালয়া তিথির গুরুত্ব অপরিসীম।
লোককথায় রয়েছে, এই মহালয়ার দিনেই কৈলাস পর্বত থেকে মর্ত্যধামে তথা হিমালয়ের কাছে বাপের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে উমা তথা দেবী দুর্গা। স্বামীগৃহ ছেড়ে পিতৃগৃহে রওনা দেয় উমা আর তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সন্তানেরা –গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী আর সরস্বতী। এই সময় বিভিন্ন বাহনে চড়ে উমা আসেন পিতৃগৃহে। লোকবিশ্বাস এবং পঞ্জিকাদি অনুসরণ করলে দেখা যায় দেবীর মর্ত্যে আগমনের বাহন বিচার করে আগামী বছরের শুভাশুভ আন্দাজ করা যায়। যেমন কথায় আছে দোলায় আগমন ঘটলে বন্যা হবে, গজে গমন ঘটলে পুণ্য-সমৃদ্ধি হবে ইত্যাদি। দেবীর এই বাহন মূলত চার রকমের হয়ে থাকে – পালকি, নৌকা, হাতি এবং ঘোড়া। শাক্তপদাবলীতে উমার আগমন এবং প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে রচিত হয়েছে বহু লোকপ্রিয় গান।
মহালয়ার দিন যে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয় সেই তর্পণের প্রথার একটা পৌরাণিক ব্যাখ্যা রয়েছে। রামায়ণে দেখা যায় ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র লঙ্কা জয় করে সীতা উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বসন্তকালে। যে কোনো শুভ কাজের সূচনায় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দেওয়ার শাস্ত্রীয় রেওয়াজ রয়েছে আর সেটাই করেছিলেন রামচন্দ্র।
মনে করা হয় তখন থেকেই তর্পণ প্রথার জন্ম। তবে মহাভারত পড়লে জানা যাবে, পরলোকে গিয়ে কর্ণকে খাবার হিসেবে সোনা আর নানাবিধ রত্ন দেওয়া হলে ইন্দ্রের কাছে কর্ণ এর কারণ জানতে চান। তখন ইন্দ্র বলেন যে দাতা কর্ণ আজীবন সোনা-রত্ন-মানিক্য সকলকে দান করে এসেছেন বটে, কিন্তু পিতৃপুরুষকে উৎসর্গ করে তিনি কখনোই খাবার বা জল দান করেননি।
এই জন্যে কর্ণকে দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যে ফিরে ষোলো দিনের জন্য পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে অন্ন-জল দান করার নির্দেশ দেন। এই সময়কেই বলা হয় পিতৃপক্ষ। যদিও মহালয়া তিথি লোকমুখে ষোলাশ্রাদ্ধ, অমরপক্ষ ইত্যাদি নামেও পরিচিত।যে নদীর ঘাটে আগের বছর বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসা একটি বছরের প্রতীক্ষা নিয়ে সেই ঘাটেই পিতৃ তর্পণের মাধ্যমে দেবীর আগমনী শুরু হয়।মহিষাসুরকে বধের মধ্য দিয়ে ত্রীলোকের শান্তি ফিরিয়ে আনেন দেবী দুর্গা। দেবীর সেই মহিষাসুর বধের দৃশ্যই কল্পনা করে তখন থেকে মর্ত্য অর্থাৎ মানবকূলে দেবী দুর্গার পূজা শুরু হয়।
মহালয়া- ২১ সেপ্টেম্বর রবিবার পড়েছে মহালয়া
মহাপঞ্চমী ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পড়েছে পঞ্চমী তিথি।
মহাষষ্ঠী- ২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠী বিহিত পূজা । মহাসপ্তমী- ২৯ সেপ্টেম্বর সোমবার, মহাঅষ্টমী- ৩ ০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মহানবমী- বুধবার ১ অক্টোবর এবং বৃহস্পতিবার ২ অক্টোবর ২০২৫ দশমী বিহিত পূজা শেষে মায়ের বিসর্জন।
২০২৫ সালে দেবী দুর্গার গজে (হাতি) আগমন এবং দোলায় গমন হবে। গজে আগমন বসুন্ধরাকে শস্য শ্যামলা করবে, যা শুভ ফল বয়ে আনবে। তবে, দোলায় গমন মড়কের আশঙ্কা তৈরি করে, যা একটি অশুভ ইঙ্গিত বহন করে।