
লুৎফর রহমান লিটন, সিরাজগঞ্জ :
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দলিল লেখক সমিতির নামে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে, যা দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ভূমি ক্রেতাদের জিম্মি করে রেখেছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কমিশন আদায় করা হচ্ছে, যার ফলে অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না।
সম্প্রতি ৫ জুলাইয়ের পর এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। বর্তমানে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জহুরুল ইসলাম, দলিল লেখক সমিতির সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক এবং দলিল লেখক সমিতির সেক্রেটারি সাহাদত হোসেন সিন্ডিকেটটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। সভাপতি ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হওয়ার পর তারা দলিল লেখকদের জন্য খাসি জবাই করে নৈশভোজের আয়োজন করেন।
ভুক্তভোগী চক কোলামুলা গ্রামের সোলায়মান হোসেন জানান, ছয় লাখ টাকায় ৩৩ শতাংশ জমি কেনার পর দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে তাকে তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা ফি চাওয়া হয়। দীর্ঘ দুই মাস পার হলেও অতিরিক্ত টাকা দিতে না পারায় তিনি এখনো দলিল নিবন্ধন করতে পারেননি।
এছাড়া, তালম গ্রামের মইনুল ইসলাম বলেন, “তিন লাখ টাকার জমি কিনেছি, অথচ প্রতি লাখে ১৭ হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন খরচ চাওয়া হচ্ছে। আমি একজন ক্ষুদ্র কৃষক, এত টাকা কোথায় পাবো?” একই ধরনের অভিযোগ করেছেন তালম গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমও। মাত্র এক লাখ টাকার জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১৫ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুইচিং মং মারমা জানান, দলিল লেখকদের সিন্ডিকেট নিয়ে মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় আলোচনা হয়েছে। সাবরেজিস্টার অফিস আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাবেন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। উপজেলা সাবরেজিস্টার মো. মাসুদ রানা জানান, ভুক্তভোগী ভূমি ক্রেতারা লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
ভূমি রেজিস্ট্রেশন আইন ২০২৪ অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতি লাখ টাকার জমি রেজিস্ট্রেশন ফি ৭,৫০০ টাকা এবং পৌরসভায় ৯,৫০০ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
৫ জুলাইয়ের পর থেকে তাড়াশ উপজেলায় দলিল লেখক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয় এবং সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসক বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার আশ্বাস দেন এবং ইউএনওকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার শরীফ তোরাব হোসেন জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত দলিল লেখকদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি নিবন্ধন অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভূমি রেজিস্ট্রেশনে অতিরিক্ত অর্থ আদায় সাধারণ মানুষের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং যথাযথ আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এ দুর্নীতির অবসান ঘটানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।