ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে এখনো শতভাগ সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছেনি, অথচ বিদ্যালয়গুলোতে লেকচার পাবলিকেশন্স কোম্পানির নোট গাইডের তালিকা পৌঁছে গেছে। এসব তালিকা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজটি করছে অনিবন্ধিত শিক্ষক সমিতি ও কিছু শিক্ষকেরা। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সমিতি মোটা অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করে নোট গাইড বাজারজাত করছে।
এ বছরও শিক্ষক সমিতির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) কামরুজ্জামান কামাল ও সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বই কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার জন্য চার সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সদস্যরা হলেন মোবারক আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান তরিকুল ইসলাম, রায়গ্রাম বাণীকান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান পলাশ মুখার্জী, সুন্দরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান ও বিএইচএবি মুন্দিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মহসিন আলী।
এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লেকচার পাবলিকেশন্স কোম্পানির নোট গাইড বিদ্যালয়ে চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও সরকার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার বই প্রদান করেছে, তবুও বিদ্যালয়গুলোতে নোট গাইডের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এসব নোট গাইড কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, এবারের নতুন সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষক সমিতি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা রয়েলটির বিনিময়ে লেকচার পাবলিকেশন্সের গাইড অনুমোদন দিয়েছে। এমনকি যাচাই-বাছাই কমিটিতে থাকা প্রতিজন শিক্ষক নাকি এক লক্ষ টাকা করে পেয়েছেন। শিক্ষকদের অনেকেই এই নোট গাইড ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও শিক্ষক সমিতির চাপে তারা বাধ্য হচ্ছেন এতে অংশ নিতে। এবারের নোট গাইড চালানোর জন্য সভাপতি হয়েছেন কামরুজ্জামান কামাল, যিনি কয়েকজন অসৎ শিক্ষকের সঙ্গে মিলে মোটা অঙ্কের টাকার লোভে এসব করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একজন অভিভাবক, সাজিদুর রহমান, ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তার সন্তানের স্কুল থেকে হলুদ রঙের একটি বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছে, যা কিনতে প্রায় ছয় হাজার টাকা লাগবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যখন সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, তখন কেন শিক্ষার্থীদের নোট গাইড কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে? অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুলের শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না, অথচ গাইড বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা খুলে বসেছেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার আব্দুল আলিম এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় তিনি নীরব ভূমিকা পালন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (অ.দা) দীনেশ চন্দ্র পাল বলেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন এবং স্কুলগুলোতে নোট গাইড চালানোর নিয়ম নেই। তিনি আশ্বস্ত করেন, রবিবার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলামও জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নোট গাইড চালানোর নিয়ম নেই। কোনো বিদ্যালয়ে এমন কিছু ঘটলে তা তদন্ত করে দেখা হবে।
ঝিনাইদহ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এ.বি.এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবৈধ নোট গাইড চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এমন ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও নোট গাইডের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের নীরবতা এই বাণিজ্যকে আরও বেপরোয়া করে তুলছে। অভিভাবকরা আশঙ্কা করছেন, কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নোট গাইড নির্ভর হয়ে পড়বে, যা তাদের সৃজনশীল শিক্ষা অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।