
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান ১০ম গ্রেডের পদে মাত্র ৭ বছর চাকুরি করে অবৈধপন্থায় ঘুষ, দুর্নীতি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ঢাকা শহরের ভবন মালিকদের জিম্মি করে হয়েছেন প্রায় ১০০ কোটি টাকার মালিক। এ যেন আলাদিনের চেরাগের গল্পকেও হাড় মানায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধ পন্থায় তিনি উওরা সেক্টর ১৭ রোয নং-৬/সি এর ব্লক-জি-১ আর এস দাগ-২০৩৪১ অবস্থিত রয়েল টাওয়ার (Royal Tower) নামের বিল্ডিংয়ে ১৫০০ স্কয়ার ফুটের ফ্লাট; পলিএনথিউচ (Polyanthus) সেতু প্রজেক্ট উওরা সেক্টর ১৭ তে আছে আরো একটি ১৫০০ বর্গফুটের ফ্লাট; মধ্যপাড়া, বাদলদি, বাউনিয়া, তুরাগ, অবস্থিত বাদলদি হাইটস (Badaldi Heights) নামের বিল্ডিয়ে রয়েছে ১২০০ বর্গফুটের ফ্লাট; মিরপুর ৬০ ফুট পীরেরবাগের আমতলা টাওয়ারে রয়েছে ১৬৩০ বর্গফুটের আয়তনের বিলাসবহুল ফ্লাট; গ-৩৬, ফলকন টাওয়ার, মহাখালী স্কুল রোড, মহাখালী, ঢাকাতে আছে তার ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি ১২০০ স্কয়ার ফুটের ফ্লাটের মালিক হয়েছেন।
এছাড়াও গাজীপুর সিটি করোপোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ডের বাউপাড়া মৌজায় আর এস দাগ নং ১১০ এ রয়েছে ২৫০ শতাংশ জমির মালিকানাধীন- ও এইচ এনাটরপ্রাইজের পক্ষে, যার বাজার মূল্য ৩ কোটিরও বেশি।
নিজ গ্রামে নিজের নামে, স্ত্রীর নামে এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ যা তদন্ত স্বাপেক্ষ বিষয়। একটি উদাহরণ হলো বাউফল উপজেলার কালিশুরী ইউনিয়নের মৌজা-বড় আড়াইনাও, এস এ খতিয়ান-৮৯ রয়েছে ৬৬.৭০ শতাংশ জমির মালিকানা।
মনিরুজ্জামানের স্ত্রী কানিজ জাহানের নামে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মৌজা-বগুড়া আলেকান্দা, এস এ ২৪১৬৮ নং খতিয়ানের ৬১৯৩ নং দাগে রয়েছে ৮.৭৫ শতাংশ জমি, যার বাজার মূল্য ৬ কোটি টাকা। উক্ত জমিতে বরিশাল সিটি করপোরেশন হতে ১৩ তলা ইমারত নির্মাণের জন্যে ছাড়পত্র গ্রহণ এবং নকশা পাশ করে বাড়ির কাজ শুরু করেছেন।
বাংলামটর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র রোডে সারিনা আশরাফ নিবাস এর নবম তলায় ৯সি নামে নিজ নামে ক্রয়কৃত ফ্লাট ১২০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র করা ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার ফ্লাটে বর্তমানে তিনি থাকেন।
নিজ নামে ও স্ত্রীর নামে ছাড়াও রয়েছে নামে-বেনামে বহু ব্যাংক ডিপোজিট, জমিজমা এবং ফ্লাট, যা কেবল ২০১৮ সালে চাকুরিতে যোগদান করে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে ঘুষ, দুর্নীতি, কর্তব্য পালনে অবহেলা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নৈতিকতা বিবর্জিত একজন ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব।
এ পর্যন্ত যতগুলো জোনে তার পোস্টিং হয়েছিল সবগুলো জায়গায় তার অপরাধের খবর সবার জানা। বিশেষ করে ইমারত মালিকদের নোটিশ করে বাণিজ্য ছিলো তার প্রধান অস্ত্র। মালিককে অভয় দিতেন যে তিনি আর নোটিশ করবেন না এবং রাজউকের উপর মহল সকলকে ম্যানেজ করতে হবে তাই ২০-৩০ লক্ষ করে রেট দিতেন একেকজন মালিককে এবং এসকল তথ্য সকলের জানা যে ২সি মনির মানেই ২০ লক্ষ টাকা। যে সকল মালিক তার এ অবৈধ দাবি মেনে নিতেন না, তাদের বিল্ডিংয়ে তিনি মোবাইলকোর্ট নিয়ে যেতেন এবং ইমারতের উপর চালাতেন বুলডোজার।
২সি মনির ইতিপূর্বে জোন ৩/১ এর কাজিপাড়া, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, ৬০ ফিট এর দায়িত্বে ছিলেন, এরপর জোন -১ এর গাজিপুরে দায়িত্বে ছিলেন। কথিত আছে ঐ সময়ে ট্রান্সকম গ্রুপের একটি বিল্ডিং নিজের বন্ধুকে ম্যাজিস্ট্রেট সাজিয়ে এবং ৪ জন পুলিশ সাথে নিয়ে ৬০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন, যা সকলের জানা। হাস্যকর ব্যাপার হলো তখন রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান তাকে ফোনে গালি দিয়েছিলেন এবং ব্যবস্থা নিবেন বলে আর পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেননি। এরপর যত জোনে তিনি পদায়ন হয়েছিলেন তা অপকর্মের ধারা অব্যাহত রাখেন। এ বিষয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত বিধি মোতাবেক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এই ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ ইমারত পরিদর্শক পতিত আওয়ামী সরকারে সময়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং নিজেকে ছাত্রলীগ সাবেক কর্মী বলে পরিচয় দিতেন। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভোল পাল্টে তিনি নিজেকে বিএনপির সমর্থক পরিচয় দিচ্ছেন এবং বিএনপির বিভন্ন মিটিং মিছিলের সাথে ছবি সাথে নিয়ে ঘুরেন।
২০১৮ সালে রাজউকে নিয়োগপ্রাপ্ত ইমারত পরিদর্শকদের মধ্যে মনিরুজ্জামানের পজিশন ১ নম্বরে, যা তার আরেক তেলেসমতি। কারণ তিনি সাবেক পতিত সরকারের দোসর এবং উপদেষ্টা এইচটি ইমামের মাধ্যমে লবিং করে লিখিত পরীক্ষায় ৮০ নম্বরে ৭৫ নম্বর পেয়েছিলেন যা তার মতো গন্ডমূর্খের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সময়ে রাজউকের প্রসাশন-১ এর উপপরিচালক মুহা. খায়রুজ্জামান ভাইভা বোর্ডে তাকে খুব আশা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু তিনি একটিরও উত্তর দিতে পারেননি, তবে নিয়োগে প্রথম হয়ে যান, কারণ ভাইভা মাত্র ২০ মার্কের ছিলো, তার মধ্যে ১০ মার্কের ছিল শুধু একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং ১০ মার্ক ছিলো মৌখিক প্রশ্নের জবাব। ২০১৮ ব্যাচের সকল ইমারত পরিদর্শক বিষয়টি জানেন এবং বিভিন্ন সময়ে সাবেক উপপরিচালক (প্রশাসন-১) এ বিষয়ে হাস্যরস এবং দুঃখ প্রকাশ করতেন বলে যানা যায়।
জানা যায়, রাজউকের দুর্নীতি পরায়ন ১৬ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যে তদন্ত দুদকে চলমান, সেখানে রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামানের দুর্নীতির বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।
দুদক, প্রধান কাযালয় হতে সহকারী পরিচালক মো. নুর আলম সিদ্দিকীকে তার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২০০ ফাইল নিয়ে অনিয়মের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। রাজউক প্রশাসন বিভাগ থেকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রাজউকের অবস্থান পরিষ্কার। দুদক চার্জশিট দিলে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক বরখাস্ত হবে। তবে আমরা এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি।’
রাজউকের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। এ বিষয়ে সংস্থার বক্তব্য জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অভিযোগ যে কারো বিরুদ্ধেই থাকতে পারে, সেটি যাচাই করতে হবে। দুদক কীভাবে তালিকা করেছে সেটা বলতে পারব না। অনেকে শত্রুতার বশেও অভিযোগ করে। তাই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যায় না।’
দুদক সূত্র জানায়, তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে চলছে।
এ পর্যায়ে সম্পদের উৎস, ক্রয়মূল্য, ব্যাংক লেনদেন, ভূমি রেকর্ড এবং সম্পদের মালিকানা যাচাই করা হচ্ছে।
উত্তরা, মিরপুর ও মহাখালী এলাকার একাধিক ভবন মালিক (পরিচয় গোপন রাখার শর্তে) জানায়— নোটিশ পাওয়া মানেই মনিরুজ্জামানের টেবিলের সামনে দাঁড়ানো। আলোচনা হয় টাকা দেয়া নাকি বুলডোজার নামবে।
রাজধানীর হাজারো নির্মাণকাজ ও ইমারত নিরাপত্তার প্রশ্ন আজ জনস্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ১০ম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা যদি সত্যিই মাত্র কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন, তবে এটি শুধু ব্যক্তিগত নয় — প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির গভীরতা চিহ্নিত করে। এখন দুদকের তদন্তই নির্ধারণ করবে—এই অভিযোগ রূপকথা, নাকি বাস্তবের নির্মম সত্য।
বি,এইচ/ নিউজ বিডি জানালিস্ট ২৪



