Wednesday, November 5, 2025

৭ ডিসেম্বর ইসলামপুর হানাদার মুক্ত দিবস গৌরবময় অধ্যায়

Date:

Share post:

জাবির আহম্মেদ জিহাদ:

ডিসেম্বর মাস বাঙালির জীবনে গৌরবের এক আলোকিত অধ্যায়। এ মাসে অর্জিত হয় বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর, পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তচ হয় জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলা।

এ দিনটি ইসলামপুরবাসীর জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্ত হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
ইসলামপুরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা, ইসলামপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানে গেরিলা আক্রমণ, প্রতিরোধ যুদ্ধ, এবং স্থানীয় জনগণের বীরত্বের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামপুর অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন পশ্চিম ইসলামপুরে একদল বীর, দরিয়াবাদ ফকিরপাড়ার সন্তান প্রয়াত শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন।
জালাল উদ্দিন ছিলেন এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, যিনি “জালাল কোম্পানি” নামে একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করেছিলেন। ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশনায় গঠিত এই বাহিনী ইসলামপুরে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চালায়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা এই বাহিনীতে যোগ দেন।
গেরিলা আক্রমণ ও প্রশিক্ষণ:
জালাল বাহিনী সিরাজাবাদ এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে মাদারি ছন আখক্ষেতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে গেরিলা যুদ্ধের তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রতিদিন তারা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প এবং রাজাকারদের স্থাপনায় আক্রমণ চালাত। এই বাহিনীর দক্ষতা ও সাহসিকতা স্থানীয়দের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছিল।

ইসলামপুর দখলের প্রস্তুতি, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর, জালাল বাহিনী ইসলামপুর দখলের জন্য চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেয়। চারটি প্লাটুনে ভাগ হয়ে তারা ইসলামপুরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে অবস্থান নেয়।
– ১ নম্বর প্লাটুন অবস্থান নেয় থানা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কোণে ঋষিপাড়া রেল ক্রসিং এলাকায়।
– ২ নম্বর প্লাটুন অবস্থান করে সর্দারপাড়া অষ্টমিটেক খেয়াঘাট সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ পাড়ে।
– ৩ নম্বর প্লাটুন থানার পূর্ব পাশে পাকা মুড়ি মোড়ে (বর্তমানে ইসলামপুর হাসপাতাল সংলগ্ন)।
– ৪ নম্বর প্লাটুন ছিল পশ্চিম বাহাদুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে।
এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা পাক সেনাদের পুরোপুরি ঘিরে ফেলে।

চূড়ান্ত যুদ্ধ ও বিজয়, ৬ ডিসেম্বর দুপুর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ টানা পরদিন ভোর পর্যন্ত চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা কোনোভাবেই টিকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার মুখে তারা অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সামগ্রী ফেলে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় বিশেষ ট্রেনে করে জামালপুরের দিকে যাওয়ার পথে ঝিনাই ব্রিজসহ তিনটি রেল ব্রিজ ধ্বংস করে, যাতে ইসলামপুরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পরদিন ৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ইসলামপুর থানা চত্বরে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। হাজারো মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে প্রয়াত কমান্ডার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ওই মুহূর্তে ইসলামপুরের আকাশ স্বাধীনতার আনন্দে মুখরিত হয়।

জালাল বাহিনীর অবদান জালাল কোম্পানি মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামপুর অঞ্চলে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ইসলামপুরের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল গেরিলা অভিযান চালিয়ে ইসলামপুরকে পাক হানাদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়।

একজন বীরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায়ের অন্যতম নায়ক, স্পেশাল জালাল কোম্পানির কমান্ডার শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামপুরের মুক্তিকামী জনগণের হৃদয়ের নায়ক।

ইসলামপুরের স্বাধীনতার গুরুত্ব:
৭ ডিসেম্বর ইসলামপুরবাসীর জন্য শুধুই একটি দিন নয়; এটি তাঁদের সাহসিকতা, ত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক। এই দিনটি কেবল ইসলামপুর নয়, পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।ইসলামপুরের হানাদার মুক্তির এই দিনটি নতুন প্রজন্মের জন্য এক প্রেরণার উৎস। জালাল বাহিনীর আত্মত্যাগ ও বীরত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কোনো সহজ প্রাপ্তি নয়। এটি অর্জনের পেছনে রয়েছে লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব।

এই ঐতিহাসিক দিনটির স্মৃতি ধরে রাখতে প্রতিবছর ইসলামপুরে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হওয়া উচিত। স্থানীয়হ প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ এই দিনটির গৌরবময় ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে আরও উদ্যোগী হতে পারেন।

৭ ডিসেম্বর ইসলামপুরের মানুষকে তাঁদের গৌরবের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি শুধু একটি এলাকার মুক্তি নয়, এটি একটি জাতির বিজয়ের অংশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

মণিরামপুরে কুকুরের আক্র”মনে ৭২ ঘন্টায় মৃ”ত্যু ১আ’ক্রান্ত ১৭জন! সর্বত্র কুকুর আ’তংক

এস এম তাজাম্মুল,মণিরামপুরঃ দেশের অন্যতম বৃহত্তর উপজেলা যশোরের মণিরামপুরে সর্বত্রই এখন বেওয়ারিশ কুকুর আতংক বিরাজ করছে। কুকুরের আক্রমন...

রামনগরে সতীঘাটায় জননেতা তরিকুল ইসলামের ৭ তম মৃ’ত্যুবার্ষিকী পালন

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: যশোর সদর উপজেলা রামনগর ইউনিয়নে ০ ৬ নং ওয়ার্ড সতীঘাটায় রূপকার বিএনপি স্থায়ী কমিটির...

সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে চাইলে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক মমতার

কলকাতা থেকে নিউজ দাতা মনোয়ার ইমাম: এস আই আর ও এন আর সি নাম করে যদি পশ্চিম বাংলার সাধারণ...

সতীঘাটায় সড়ক দুর্ঘ”টনায় গৃহবধূ আহ”তের ঘটনায় সড়ক অব”রোধ

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: যশোরের সতীঘাটায় সুমনা (৩৫)নামে এক গৃহবধূ সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের ঘটনায় ঘন্টা ব্যপি সড়ক অবরোধ...