Thursday, November 6, 2025

প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও মানবাধিকার  ——–এ্যাড: এফ,এম,এ রাজ্জাক

Date:

Share post:

মানুষ আদিকাল থেকে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে সংগ্রাম করে আসছে। ক্রমেই তাদের মধ্যে নিজেদের অধিকার আদায়ের রক্ষার আগ্রহ দানা বেঁধে উঠে। ফলে মানুষ তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে প্রকৃতি, আবহমান অবস্থা কখনো কখনো তাদের প্রত্যাশা পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। বাঁধাগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম অন্যতম।
প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়ে থাকে সাধারণত প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান দৈহিক বৃদ্ধির সময় না পাওয়া এবং জন্মের সময় নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে। এছাড়া, অন্যান্য কারণগুলো হলো যথা অস্বাভাবিক জন্ম, অনভিজ্ঞ ধাত্রীদের অবিচক্ষণতা, অপ্রতিকুল পরিবেশ। সর্বোপরি অনভিজ্ঞ ডাক্তার অথবা তার অসাবধানতা বা সময়মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থা অনেক সময় দায়ী, বিশেষ করে অক্সিজেন সিলিন্ডার যা অনেক সময় প্রসূতির ঘরে না থাকা। আবার স্বাভাবিক শিশু বা মানুষের প্রতিবন্ধী হওয়ার জন্য দায়ী সামাজিক অব্যবস্থা, সড়ক দুর্ঘটনা, সংঘাত, কলহ, মারামারি ইত্যাদি অনেকাংশে দায়ী।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের যে সর্বজনীন ঘোষণাপত্র জারি করে তা মানবাধিকারের প্রথম আন্তর্জাতিক দলিল। পরবর্তী সময়ে মানবাধিকারের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ওই দলিলের সূত্র ধরেই দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। এ দলিলে সকল মানুষের সম-অধিকার ও মর্যাদার বিভিন্ন ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে বিশেষভাবে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে বিবিধ ঘোষণা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধীদের প্রতিই প্রথম জাতিসংঘের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি ঘোষণা গৃহীত হয়। এ ঘোষণায় মানসিক প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এরপর ১৯৭৫ সালে গৃহীত হয় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের ঘোষণা।
এ ঘোষণা দুটির পর জাতিসংঘ আরও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন ১৯৮১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ সময় থেকে রাষ্ট্রসমূহ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বিশেষভাবে মনোযোগী হতে শুরু করে। একবছর পর জাতিসংঘ ১৯৮৩-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ‘প্রতিবন্ধী দশক’ হিসেবে ঘোষণা করে, যার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য গৃহীত কার্যক্রম ত্বরান্নিত করা।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা, রাষ্টীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজন বলে বাংলাদেশ সরকার ’বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ নামে একটি আইন প্রনয়ন করে। এ আইন বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের পথে একটি যুগান্তকারী ও কার্যকর পদক্ষেপ। উক্ত আইনে বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনকে লক্ষ্য করে বিশেষ ধরনের নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় জাতিসংঘ প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসেবে পালনের জন্যে সরকার, জাতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থগুলোর প্রতি আহ্বান করে। শুরু হয় প্রতিবন্ধী অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ। বাংলাদেশ পরিসংখান ব্যুরোর জুন-আগস্ট ২০০২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৬.০৪ জন মানুষ প্রতিবন্ধী কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০% লোক কোনো না কোনভাবে প্রতিবন্ধী। এ সমীক্ষা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশের প্রতিবন্ধীরা ৮০% গ্রামে বাস করে।
আন্তর্জাতিক হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ১০% মানুষ প্রতিবন্ধী। প্রকৃতি অনুযায়ী প্রতিবন্ধীদেরকে ৪ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে যথা (১) মানসিক প্রতিবন্ধী; (২) শারীরিক প্রতিবন্ধী; (৩) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং (৪) শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তবে চরম দারিদ্রতা, অস্বাস্থ্যকর প্রসব ব্যাবস্থা, ডাক্তারদের ভূল চিকিৎসা বা প্রসবকালিন ভূল সিদ্ধান্ত, দুর্ঘটনা ও সংঘাত, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, পুষ্টিহীনতা বিশেষ করে আমিষের ঘাটতি, ভিটামিন ’এ’, আয়োডিন, আয়রনের অভাব প্রতিবন্ধিতার জন্যে প্রধানত দায়ী।
বাংলাদেশে নিকট অতীত পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপণের জন্যে পূর্নাঙ্গ কোন জরিপ পরিচালিত হয়নি। আর হলেও তা নির্ভরযোগ্য সংখ্যা নিরুপণ করতে পারেনি। তবে তুলনামূলকভাবে গ্রামে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা অনেক বেশী এবং শহরের অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এছাড়া দেশের সকল ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো তারাও স্নেহ-ভালোবাসার পাত্র, তারাও প্রিয়জনদের ভালোবাসতে ও তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে চায়। প্রতিবন্ধী শিশুরা সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুদের মতো অন্যান্য সকল সুবিধার পাশাপাশি উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পায় না বলে ক্রমান্বয়ে তারা স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে সরে যায়।
তাদের প্রতিবন্ধীতা পরিবারের কাছে প্রায়শই লজ্জাজনক বলে অনুভূত হয়। ফলে তারা পরিবার, সমাজ তথা নিজের কাছে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হয়। উপযুক্ত শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে তারা না পারে নিজের জন্য কিছু করতে, না পারে পরিবার বা সমাজকে কিছু দিতে। দেশের কাছ থেকে যেমন তারা তাদের অধিকার পায় না, তেমনি দেশের প্রতিও তারা দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় না। এছাড়া রয়েছে প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার ও ভুল ধারণা।
উপরোক্ত বিভিন্ন বিষয়গুলোর অসুবিধার কথা অনুধাবন করে প্রতিবন্ধীদের সার্বিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ নামে একটি যুগান্তকারী আইন প্রণয়ন করেন। তবে প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে স্বাবলম্বী ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং দেশের অন্যান্য নাগরিকদের মতো যোগ্য করে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন,এগুলো হলো- ১. সমস্ত প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা নিরুপণ করে তাদের সনাক্তকরণ নম্বর ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিচয়পত্র প্রদান। ২. প্রত্যেক প্রতিবন্ধীকে মাসিক ভাতা প্রবর্তন। ৩. তাদের মেধা বিকাশের জন্য সারাদেশে স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। ৪. প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ডাক্তার, সেবিকা ও সাহায্যকারীদের দ্বারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা এবং ৫. কোনো চাকুরীজীবী ব্যক্তির যদি প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে তবে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর প্রতিবন্ধী সন্তানের থাকা-খাওয়া ও চলার জন্য সে ব্যক্তির অবসর ভাতা প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেতে থাকবে। যা আরও একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এবং তার সুযোগ্য কন্যা বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধীদের জন্য আরও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন প্রতিবন্ধীদের ভোট দেবার অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যে সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

মণিরামপুরে অবৈ’ধযানে কে’ড়ে নি’লো ২টি তা’জা প্রা”ন এলাকায় শো”কের ছা”য়া

এস এম তাজাম্মুল,মণিরামপুরঃ মনিরামপুরের খেদাপাড়া ইউনিয়নের চাঁদপুর এলাকার রনজিত দাস যিনি পেশায় একজন কলেজ শিক্ষক ও তার স্ত্রী...

নড়াইলে সদরে ৭ লক্ষ টাকার ন”কল বীজ ধংশ ব্যবসায়ীকে  জ”রিমানা

সাজ্জাদ তুহিন নড়াইল প্রতিনিধি : নড়াইল সদর উপজেলায় বিপুল পরিমাণ ভেজাল বীজ জব্দ ও ধংশ করা হয়েছে। এ ঘটনায়...

যশোরে মির্জা ফখরুল ইসলামের আগমনে মণিরামপুরে শুভেচ্ছা মিছিল-ও লিফলেট বিতরণ

এম ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: ৬ই নভেম্বর, যশোর টাউনহল ময়দানে, সাবেক মন্ত্রী, ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত...

বগুড়া সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়ন বিএনপির আয়োজনে আনন্দ মিছিল

রিপন বগুড়া প্রতিনিধি ঃ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৬ সদর আসনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান মনোনীত হওয়ায় মঙ্গলবার...