Monday, March 24, 2025

গাজীপুরে নৌকা পরাজয়ের একাধিক কারণ 

Date:

Share post:

আলিফ আরিফা,গাজীপুর প্রতিনিধি:

নানা হিসেব-নিকেশ ও জল্পনা-কল্পনার পর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জিতে বিজয়ের হাসি হাসছেন স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী জায়েদা খাতুন। এই পদে হেভিওয়েট প্রার্থী মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে পরাজিত করে নগর ভবনের চাবি পেলেন তিনি। ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তি ইমেজ ও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালবাসার কারণেই জায়েদা খাতুনের বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন তার আমজনতা।

পক্ষান্তরে আলোচনা চলছে নৌকা প্রার্থীর পরাজয় নিয়ে। নানা বিচার-বিশ্লেষণ আর আলাপ-আলোচনার মধ্যে মোটাদাগে উঠে আসছে আওয়ামীলীগের অন্তঃকোন্দল, দলীয় বিভাজন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী মনোভাবের পাশাপাশি বিএনপি সমর্থক ভোটারদের বড় ভূমিকার কথা। শনিবার নগরীর বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ, আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী ও বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে আওয়ামীলীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পরাজয়ের নেপথ্যের বহু কারণ।

আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন- গাজীপুর মহানগরে আওয়ামীলীগের দলীয় বিভাজন আছে। দীর্ঘদিনেও ওই বিভাজন শেষ করা যায়নি। উল্টো এক পক্ষ অপরপক্ষকে ঘায়েল করতেই ব্যস্ত থাকতো অধিকাংশ সময়। এর রেশ পড়েছে এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিস্কারের পর মহানগর আওয়ামীলীগ কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য পদধারী নেতাকে দল থেকে কেন বহিস্কার করা হবে না, এই মর্মে চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। গত ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের পরেও এ পর্যন্ত মহানগর কমিটি গঠন করতে না পারার বিষয়টিও আওয়ামীলীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে।

এমন অবস্থায় নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামীলীগের তৃণমূলের একটি অংশ জাহাঙ্গীরের পক্ষে চলে আসে। তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে নৌকার ব্যাজ পড়লেও গোপনে জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের পক্ষে কাজ করেছেন। এমন অভিযোগে নির্বাচনের প্রচারণার সময়ও দলের তিনজন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে আটজন নেতা-কর্মীকে। এছাড়া পুলিশ দিয়ে আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আওয়ামীলীগের প্রার্থীর পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল এই দলীয় কোন্দল ও বিভাজন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যে- নির্বাচনের দিন কেন্দ্রগুলোতে নৌকার কর্মীদের আধিক্য থাকলেও দিনশেষে সেখানে জয়ী হয় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের ঘড়ি প্রতীক। মূলত আওয়ামীলীগের অনেক নেতা-কর্মীই নৌকার লোক বেশে ভোট দেন জায়েদা খাতুনকে। ভোটের আগে অভিযোগ ওঠে, সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের অনুসারীরা যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারেন, সেজন্য ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার ও ঘরছাড়া করা হয় অনেককে। তবে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য জায়েদা খাতুনের ভোটার ও কর্মী সমর্থকরা কৌশল হিসেবে গলায় নৌকার ব্যাজ ও হাতে নৌকার ভোটার স্লিপ নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। আর এই কৌশলের কাছে হেরে যান আজমত উল্লা খান।

জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষের কতিপয় আওয়ামীলীগ নেতার মতে- নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তারা নিশ্চিত ছিলেন চাপের মুখে জাহাঙ্গীর নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে যাবেন। তবে শেষ পর্যন্ত নানা চাপ থাকা সত্ত্বেও মাঠ ছাড়েননি জাহাঙ্গীর। এছাড়া ভোটারদের ওপরও নৌকার বাইরে ভোট না দিতে হুমকির অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। দলীয় মনোনয়নন পেলেই জয় নিশ্চিত এমন ধারণায় আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকেন আওয়ামীলীগের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা। যার প্রভাব পড়ে ব্যালটে।

নগরের বাসিন্দাদের মতে- আওয়ামীলীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খানের নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। মহানগরের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের কাজে না লাগিয়ে কেন্দ্র ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীদের নিয়ে আসা হয় নির্বাচনী প্রচারণার কাজে। বিচ্ছিন্নভাবে তারা প্রচার-প্রচারণা চালান। রাস্তা-ঘাটে দায়সারা প্রচারণা চালালেও ভোটারদের ঘরে পৌঁছায়নি নৌকার বার্তা। এতে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ৫৭টি ওয়ার্ডে দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় তারা নিজেদের প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অনেকেই বিএনপির ভোট পেতে নৌকার পক্ষে সরাসরি ভোট চাওয়া থেকে বিরত ছিলেন। এসব কর্মকাণ্ডও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

অনেকেই বলেন- একাই নানা পথসভায় বক্তব্য দিয়ে গেছেন আওয়ামীলীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। তিনি জাহাঙ্গীর আলমের দুর্নীতি, নগর ভবনের দুর্নীতি নিয়ে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এ নগরে সরকারের নেয়া নানা উন্নয়ন প্রকল্প তিনি ভোটারদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। নগরীর উন্নয়ন নিয়ে তার ভাবনায় ছিল না কোনো পরিকল্পনার ছাপ, শুধু বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছেন। তার একই ধরনের বক্তব্যে নাখোশ ছিলেন নগরীর অনেক মানুষ। প্রচারণায় ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন। তরুণ প্রজন্ম ও নারীদের আকৃষ্ট করতেও কোনো ভূমিকা নিতে পারেননি আজমত উল্লা খান।

নারী প্রার্থী জায়েদা খাতুন প্রচারণায় নেমে আজমত উল্লা খানের এলাকা টঙ্গীতে প্রবেশ করে বারবার বাধার শিকার হয়েছেন। তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, কর্মীদের রক্তাক্ত করা হয়েছে। এভাবে প্রচারণায় বাধা ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে ছিল। নন্দিত বাংলা সিনেমা ‘আম্মাজান’র শিরোনাম গান চালিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালান জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা জায়েদা খাতুন। অনেকেই মনে করেন- এই গানে আবেগতাড়িত হয়েছেন অনেক ভোটার। বিশেষ করে নারীরা ও আবেগী ভোটাররা রায় দেন জায়েদা খাতুনের পক্ষে।

নগরের ভোটারদের মতে- সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার প্রায় ১২ লাখ। এর অর্ধেকের বেশী ভোটারই নারী। প্রথমবারের মতো এই সিটিতে একজন বয়স্ক নারী মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ায় এবং ছেলের জন্য মায়ের সংগ্রামে আকৃষ্ট হন নারী ভোটাররা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

পাইকগাছায় কৃষক দল নেতার বি’রুদ্ধে চাঁ”দা দাবি ও হু”মকি’র অ’ভিযোগ

পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি ॥ পাইকগাছা উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক মেছের আলী সানার বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের হুমকি...

গোদাগাড়ীতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে ফুড প্যাক উপহার

মোঃ মাসুদ আলম, ব্যুরো চীফ, রাজশাহী: মাহে রমজান উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গোদাগাড়ী উপজেলার উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে ফুড...

সবুজ পৃথিবী কালিহাতী উপজেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠন

বুলবুল হোসেন: পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সবুজ পৃথিবীর কালিহাতী উপজেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৪ মার্চ, সোমবার কালিহাতীর...

কালীগঞ্জে পান বোঝায় আলম সাধু ছি’নতা’ই 

হুমায়ুন কবির, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে পান বোঝায় একটি আলম সাধু ছিনতাই এর ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (২৪ মার্চ) ভোরে...