Sunday, May 18, 2025

এক যুগ ধরে শিকলে বন্দী জীবন-বিকাশ সরদারের

Date:

Share post:

সুমন হাসান,কয়রা(খুলনা)প্রতিনিধি:

কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের কিনারে একটি বাবলাগাছ ও পায়ের সঙ্গে লাগানো শিকলই বিকাশ সরদারের প্রতিটি দিন–রাতের সঙ্গী। দিন-রাত একটি ত্রিপলের নিচে শিকলে বাঁধা অবস্থাতেই থাকতে হয় তাঁকে। ঝড়–বৃষ্টি হলে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। থামলেই আবার সেখানে। এভাবেই ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ৪৬ বছরের বিকাশ সরদারের এই শিকল বন্দিজীবন।

শিকল খুলে দিলে মানুষকে বিরক্ত করেন, ঘরে ঢুকে আসবাব ভাঙেন তিনি। অনেক সময় এদিক-সেদিক চলে যান। ভাইয়ের এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সামাল দিতে দিতে বেসামাল হয়ে পড়েছেন বোন রেখা সরকার। বাধ্য হয়ে তাই ছোট ভাইয়ের পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। বাবা-মা বেঁচে না থাকায় বোন রেখা সরকার ও ভগ্নিপতি স্বপন সরকারের সংসারেই ঠাঁই পেয়েছেন মানসিক প্রতিবন্ধী বিকাশ।

খুলনার কয়রা উপজেলার কাশিরহাটখোলা থেকে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ধরে হাজতখালী গ্রামের দিকে গেলে বেড়িবাঁধের পাশে দেখা মিলবে শিকলে বাঁধা বিকাশ সরদারের। তিনি কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের মৃত গৌর পদ সরদারের ছেলে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। শান্তশিষ্ট ছেলে হিসেবে গ্রামের সবাই তাঁকে আদর করতেন। কিন্তু হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি। ৩০ বছর ধরে মানসিক সমস্যা দেখা দিলেও পায়ে শিকল পড়েছে ১২ বছর ধরে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের পাড়ে বেড়িবাঁধের ঢালে ত্রিপলের নিচে একটি বাবলাগাছের সঙ্গে পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা বিকাশ সরদার। খালি গায়ে একটি ময়লা লুঙ্গি পরে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন। পাশে একটি গায়ে দেওয়ার কাঁথা এলোমেলো করে রাখা। সঙ্গে রয়েছে একটি গামলা ও পানির জগ। সেখানেই খাবার দেওয়া হয় তাঁকে। বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীরা বিকাশ সরদারের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না। এটা হয়তো পথচারীদের কাছে প্রতিদিনের দৃশ্য, তাই খুব একটা গায়ে মাখছেন না কেউ। বিকাশ সরদারকে ডাকলেও সাড়া দিতে চান না। শুধু পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

রেখা সরকার বলেন, ‘বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ১৪ বছর ধরে এই ভাইকে টানছি। আমরাও গরিব মানুষ। যেটুকু সামর্থ্য ছিল, তা দিয়ে ভাইটাকে ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছি। তবে অর্থের অভাবে এখন ভালো কোনো চিকিৎসকের কাছে তাঁকে নিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে দিন–রাত ভাইকে এভাবে বেড়িবাঁধের পাশে বেঁধে রাখা লাগে। প্রস্রাব–পায়খানাও ওই খানে করে। পরে আমি পরিষ্কার করে ফেলি।’ তিনি আরও বলেন, বিকাশ প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তবে সরকারি সহায়তা কিংবা সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে হয়তো তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন।

বিকাশ সরদারের ভগ্নিপতি স্বপন সরকার বলেন, ‘বিকাশ অনেক মেধাবী ছিল। গ্রামের সবাই তাঁকে ভালো জানতো। কিন্তু হঠাৎ করে কী কারণে এমনটা হলো তা বলতে পারবো না। এলাকার ছোট ছেলেমেয়েরা ওকে দেখলে ভয় পায়। আবার ছেড়ে রাখলে এদিক-ওদিক চলে যায়। এই জন্যই তাঁকে আমাদের বেঁধে রাখতে হয়।এর আগে বিকাশকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে বেশি দিন চিকিৎসা করাতে পারেননি।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি সত্যিই হৃদয়বিদারক। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। দ্রুতই বিকাশ সরদারের খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

রাজউকের নির্মাণ বিধিমালা না মেনে নির্মিত হচ্ছে ভবন

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকায় ইমারত নির্মাণে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তৈরি হচ্ছে ইমারত। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর নির্মাণ আইন...

মণিরামপুর তালপুকুরে জমকালো ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত

ইমদাদুল  হক, মণিরামপুর প্রতিনিধি: যশোরের মণিরামপুর উপজেলার কাশিপুর তালপুকুর মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। শত বছরের...

মনিরামপুরে উন্নয়নের গতি ইউএনও নিশাত তামান্নার নেতৃত্বে নতুন আশার সঞ্চার

ইমদাদুল  হক, মনিরামপুর প্রতিনিধি: যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার ৯নং ঝাঁপা ইউনিয়নে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর সমাধানে সরেজমিনে পরিদর্শনে যান উপজেলা...

হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের স্মৃতি বাংলার ঐতিহ্য ঘুড়ি

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ঘুড়ি উড়ানো। একসময় গ্রীষ্মকাল এলেই আকাশ রঙিন...