Sunday, August 24, 2025

যশোরের ৯৬ গ্রামে শুরু শুরু হয়েছে চড়কপূজা

Date:

Share post:

স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ

যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার হেলারঘাট মহাশ্মশানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লোকজ ধর্মীয় উৎসব চড়কপূজা।

সাতদিন যাবত চলমান চড়কপূজার ষষ্ঠদিন শনিবার ( ১২ই এপ্রিল) বিকাল সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠিত হয় চড়কপূজার মূল আকর্ষক খেজুর ভাঙা। একঘন্টা ব্যাপি চলমান খেজুর ভাঙায় অর্ধশত সন্ন্যাসী খেজুর ভাঙায় অংশগ্রহণ করেন।

আগামীকালও অনুষ্ঠিত হবে খেজুরভাঙা,মালঞ্চভাঙাসহ শিবের বহুবিধ পূজা।চলমান ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসব উপলক্ষ্যে ৯৬ গ্রামসহ সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চলছে উৎসবের আমেজ।

উল্লেখ্য বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য লোকগাঁথা,লোকজ উৎসবে ভরপুর। বার মাসে তের পার্বন যেন বাঙালির হৃদয়কে আন্দোলিত ও বিমোহিত করে।বাংলা বার মাসের নামের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে চাঁদের ২৭ নক্ষত্রের সম্পর্ক তেমনি জড়িয়ে আছে ঋতু পরিক্রমার সাথে সাথে প্রকৃতি,পরিবেশ ও সামাজিক/ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সম্পর্ক। চাঁদের একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৮ দিন সময় লাগে। প্রদক্ষিণকালে চাঁদ বিভিন্ন নক্ষত্রের কক্ষপথে অবস্থান করে।সর্বশেষ চাঁদ অবস্থান করে চিত্রা নক্ষত্রে তাই বাংলা বার মাসের শেষ মাসের নাম হয়েছে চিতা বা চৈত্র। আর এ সময় বিশেষ করে চৈত্র মাসের শেষ দিনে বাঙালি হিন্দুরা মেতে ওঠে চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়কপূজা বা গাজনে।

চড়ক পূজা অতি প্রাচীন কাল থেকে পালিত হয়ে আসছে।ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের যশোর- খুলনা-বরিশাল-মাগুরা-ফরিদপুর-নড়াইল,ভোলা,চট্টগ্রাম,নোয়াখালী,রংপুর,রাজশাহীসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়।তারইধারাবাহিকতায় যশোর জেলার মনিরামপুর-অভয়নগর উপজেলার সীমান্তবর্তী ৯৬ গ্রামের হেলারঘাট মহাশ্মশানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা।

চৈত্র সংক্রান্তির ১৫ দিন,১১ দিন, ৭ দিন অথবা ৩ দিন আগে থেকে শুরু হয় চড়ক পূজার প্রস্ততি। পূজার প্রস্তুতি শুরু হয় গ্রামের বারোয়ারি গাছতলায়, শ্মশানে কিংবা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়।
বেল কাস্ট দ্বারা নির্মিত মহাদেবকে চৈত্রমাসের ১৫ দিন, ১১ দিন,৭দিন,৩দিন বা দিনের দিন স্নান করিয়ে সিঁদুর ও সরিষার তেল মাখানো হয়।তারপর লালচি দিয়ে ভালভাবে জড়ানো হয়।পরানো হয় আকন্দ, জবা,বেলী, গাঁদা ফুলসহ বেল পাতার তৈরি মালা দ্বারা ।লাগানো হয় স্বর্ণের চোখ।চড়ক গাছের ক্ষেত্রে আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়।এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে “শিবঘট “বা‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত।
চড়ক পূজার সন্ন্যাসীরা পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করেন এবং বেলকাঠ দিয়ে নির্মিত মহাদেবকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিবের গাজন গেয়ে বেড়ান।

চড়ক পূজা কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজা আরম্ভ করলেও চড়কপূজা কখনও রাজ-পরিবারে তেমন বিশেষ মর্যদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল না বলেই ইতিহাসে প্রমাণ দেয়। এটি ছিল হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি।তবে জনশ্রুত রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজার প্রচলন করেন।এ পূজার অপর নাম- নীল পূজা, মহাদেব পূজা, গম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন ।

শিব- পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীত ও ধর্মীয় নাটক অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় ।সর্বস্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন হলেও নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে চড়ক পূজার প্রচলিত ছিল। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয়।
পূজার সন্ন্যাসীদের কয়েকজনের একটি দল চড়ক পূজার শুরুতে শিবপাঁচালী পাঠক বা বালা মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন । এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা বা শিবপাঁচালী পাঠক।সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়।

তারপর সন্ন্যাসীরা কাষ্ঠ নির্মিত মহাদেবকে নিয়ে বাড়ী বাড়ী ঘুরে সংগ্রহ করেন চাল, তরকারী,বিভিন্ন ফল, বাতাসা আর টাকা।
এ পূজার কয়েকটি বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য,খেঁজুর ভাঙ্গা, চড়কগাছে দোলা এবং হাজরা পূজা করা।

চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ ফুল-ফল নিয়ে বাদ্যযন্ত্র সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করেন।এছাড়া দেবতার প্রতি অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য কাঁটাজাতীয় খেজুর গাছে মাথায় চড়ে গাছের খেজুর ভেঙে ভক্তদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন এবং গাছ থেকে নামার সময় খেজুরের থোকা মুখে নিয়ে উল্টোভাবে গাছ থেকে নেমে আসেন।

পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। তখন সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় অভিভাবকরা শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন । সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদও করেন।তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছড়ান।

এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস ইহজগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার পথকে সুগম করে দিবেন।পূজার সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বর্ণ ও সম্প্রদায়ের লোক। এ পূজায় কোন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন পড়ে না। তবে দেউল ও নীল পূজায় ব্রাহ্মণের দরকার হয়।

এই সব পূজার মূল উপজীব্য ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর মূল লক্ষ্য থাকে দেবতা শিবের আবাহন। শিবই এই উৎসবের মুখ্য। তাই শিবকে সন্তুষ্ট করাই পূজারীদের উদ্দেশ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক জমি-ভবনের ন্যায্য মূল্যের দা’বিতে সংবাদ স’ম্মেলন

হুমায়ুন কবির , কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ: ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে অধিগ্রহণকৃত জমি ও ভবনের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের দাবী...

খাগড়াছড়িতে ৩৩ লাখ টাকায় নবনির্মিত প্রধান ফটক উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা রাষ্ট্রদূত (অব:) সুপ্রদীপ চাকমা

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি জেলার শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবনির্মিত প্রধান ফটক শুভ উদ্বোধন করেন করেছেন...

রামনগরে বিএনপি’র নতুন সদস্য নবায়ন ও সদস্য সংগ্রহ চলমান কার্যক্রমে জ’রুরি সভা 

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: যশোর সদর উপজেলা রামনগর ইউনিয়নে বিএনপি'র তৃণমূল পর্যায় সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ...

কালীগঞ্জে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে মিলছে না সেবা গ্রাহক হ’য়রানির অ’ভিযোগ 

হুমায়ুন কবির(কালীগঞ্জ)ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ৬ নং ত্রিলোচনপুর  ইউনিয়নের সাবেক ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা  ইকবাল হোসেন এবং জেলা...