Saturday, July 26, 2025

আজ ১৩ নভেম্বর রাজগঞ্জের ইতিহাসে চরম নৃশংসতম দিন

Date:

Share post:

ডেস্ক রিপোর্ট ঃ

আজ ১৩ নভেম্বর। দেশের প্রথম স্বাধীন জেলা যশোর। জেলার মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের ইতিহাসের চরম নৃশংসতম দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে মুক্তিযোদ্ধের প্রাক্কালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন দশজন স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী নিরীহ বাঙ্গালী। সেই সময় ভয়াবহ এই ঘটনার স্বাক্ষী হতে হয়েছিল রাজগঞ্জবাসীকে। পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকাররা মিলে দশজনকে হাত—পা—চোখ বেঁধে রাইফেলের বেনেয়েট দিয়ে খঁুচিয়ে খঁুচিয়ে লবন ছিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে দেশের সেই বীর যোদ্ধাদের আজো সঠিকভাবে সম্মান জানাতে পারেনি মনিরামপুর উপজেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গনের কেউ।
রক্তস্নাত এই দেশটির অভ্যূদয়ের এতো বছর পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি পাননি ওই দিন প্রাণ বিলিয়ে দেয়া রাজগঞ্জের সেই ১০ শহীদ। গড়ে তোলা হয়নি তাদের স্মরণে কোন স্মৃতিস্তম্ভ। উপরন্ত সেই বীর সেনানীদের গণকবরটি এখন কশাইখানা, মাছের আড়ৎসহ বরফকলে পরিণত হয়েছে। এমনকি শহীদদের অসহায় পরিবারের সদস্যদেরও কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা বা খোঁজ—খবর নেয়নি স্থানীয় রাজনীতিবীদসহ কোন মুক্তিযোদ্ধারাও। ওই শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, ১৩ নভেম্বর রাজগঞ্জে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে উজ্জলপুর মাঠে পাক বাহিনীর সাথে সম্মূখযুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিবাহিনী। ওই যুদ্ধে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। প্রতিশোধ হিসেবে ১৩ নভেম্বর সকাল ১০ টার দিকে পাক বাহিনীর দোসর এদেশীয় রাজাকাররা ঝাঁপা ইউনিয়নের কোমলপুর গ্রামের সংখ্যালঘু পাড়ায় হানা দেয়। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলো মনিরামপুর উপজেলার পাতন গ্রামের মৃত মেহের আলী ওরফে মেহের জল্ল¬াদ, হাজরাকাটি গ্রামের আফসার আলী ও রতনদিয়া গ্রামের আজিজুর রহমান প্রমূখ।
রাজাকাররা এ সময় ওই পাড়া থেকে মুক্তিকামী মৃত দিজুবর সিংহের ৩ ছেলে মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র নাথ (৩৫)নরেন (৩০)ও হরেন (২৭), মৃত সূয্যর্ সিংহের ছেলে নিতাই চন্দ্র সিংহ (৩০) হাজারী লাল সরকার (৫৫) তার ছেলে পরিতোষ (২৪)ও কালিপদ সরকারের ছেলে রামপদ (৩০)কে ধরে নিয়ে যায়। পাক হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকাররা ওই সময় বাড়ির নারীদের উপরও নির্যাতন চালায়। এরপর ওই পাড়া থেকে ৭ জন এবং মশ্মিমনগর ইউনিয়নের নোয়ালী গ্রাম থেকে মৃত বাসতুল্ল্যাহ গাজীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ডা. আনিছুর রহমান (২৮) ডা. দিনআলী গাজী (৩০)ও একই গ্রামের সৈয়দ আলীর ছেলে কলেজ ছাত্র আজিজুর রহমান (২৫)সহ ১০জনকে ধরে আনা হয় রাজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রাজাকার ক্যাম্পে।
সেখানে নিয়ে আটককৃতদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়। ১৩ নভেম্বর দুপুর ১টার দিকে আটককৃত ১০ জনকে দঁড়ি দিয়ে হাত—পা ও চোখ বেঁধে বাজারের বটতলায় আনা হয়। সেখানে মেহের জল¬াদের নেতৃত্বে ১৫/২০জনের একদল রাজাকার প্রথমে নোয়ালী গ্রামের বাসতুল্ল্যাহ গাজীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার আনিছুর রহমানকে গুলি করে ও বাকি ৯জনকে রাইফেলের বেনেট দিয়ে খঁুচিয়ে খঁুচিয়ে লবন ছিটিয়ে হত্যা করে। হত্যা শেষে ওই দশ জনের লাশ রাস্তার পরে ফেলে রেখে রাজাকাররা উল্ল¬াশ করতে করতে পূনারায় ঝাঁপা ইউনিয়নের কোমলপুর গ্রামে ঢুকে দ্বিতীয় দফায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালায়।
পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নিহত মুক্তিকামী নিতাই চন্দ্র সিংহের দুই ছেলে মৃত্যুঞ্জয় সিংহ ও সঞ্জয় সিংহ বেশ ক্ষোভের সাথে জানান, তাদের বাবাকে রাজাকাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জয় বাংলা শ্লোগান দেয়ায় তাদের বাবাকে রাইফেলের বেনেট দিয়ে খঁুচিয়ে খঁুচিয়ে লবন ছিটিয়ে হত্যা করে রাজাকার বাহিনী। আজ স্বাধীনতার ৫২বছরেও বাবা হত্যার বিচার পাইনি। পাইনি সরকারি কোন অনুদান বা সহযোগিতা। এক প্রশ্নের জবাবে বড় ছেলে মৃত্যুঞ্জয় সিংহ বলেন, ভাতা তো দুরের কথা এখনও দেয়া হয়নি বাবার মুক্তিযোদ্ধার কোন স্বীকৃতি। ফলে চরম মানবেতর জীবন যাপন করেছে নিতাই চন্দ্র সিংহের পরিবারসহ নিহত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সকলের পরিবার।
১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর রাজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীসহ অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাসহ ওই দশজন নিরীহ মুক্তিকামী বাঙ্গালীর নৃশংস হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। এদিকে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা লাশ নিতে আসতে সাহস না পাওয়ায় বিকাল পর্যন্ত ওই ১০ টি মৃতদেহ বাজারের বটতলায় পড়ে ছিলো।
ফলে রাজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ও সহকারি মুক্তিযোদ্ধা মরহুম তবিবর রহমান খাজা, মরহুম আব্দুল মান্নান, মরহুম আতিয়ার রহমান, মরহুম দেলোয়ার হোসেন ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মরহুম তোফাজ্জেল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন মিলে রাজগঞ্জ বাজার সংলগ্ন ঝাঁপা বাওড়ের পাড়ে সরকারি খাসজমিতে কবর খুঁড়ে এক কবরেই ৯জনকে মাটি চাঁপা দেয় এবং বাসতুল্ল্যাহ গাজীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা ডা. আনিছুর রহমানের মৃতদেহ তার স্বজনেরা নিয়ে নোয়ালী গ্রামে নিজ বাড়িতে দাফন সম্পন্ন করেন।
আনিছুর রহমানের ছেলে রাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের সহকারি অধ্যাপক আমিনুর রহমান সাগর জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত তার পিতার লাশ রাজগঞ্জ বাজার বটতলা থেকে নিয়ে মশ্মিমনগর ইউনিয়নের নোয়ালী গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
পাকবাহিনীর হাতে নিহত শহীদদের কথা চিন্তা করে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে গনকবরের ওই স্থানটিতে শহীদদের স্বরনে একটি ম্যুরাল উদ্বোধন করেন মনিরামপুরের প্রয়াত এমপি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট খাঁন টিপু সুলতান। তার মৃত্যুর পর গণহত্যা দিবসের এ দিনটি নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা।
এব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ও ঝাঁপা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এস.এম.কওসার আহম্মেদসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী এবং এলাকাবাসির দাবি গনকবরের স্থানটি দখল মুক্ত করে পাকবাহিনীর হাতে নিহত শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধার পক্ষের সরকার জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।

জি,এম বাবু / নিউজ বিডি জার্নালিষ্ট ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

সম্পর্কিত নিবন্ধ

যশোরে রামনগর ইউনিয়ন পরিষদে স্ব’ল্পমূল্যে টিসিবির পণ্য বিতরণ

ওয়াজেদ আলী,স্টাফ রিপোর্টার: যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়ন পরিষদে স্বল্পমূল্যের কার্ডধারীদের মাঝে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর পণ্যসামগ্রী...

টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন কলকাতার শহরের বহু এলাকা

কলকাতা থেকে নিউজ দাতা মনোয়ার ইমাম: গতকাল দিল্লীর মৌসম ভবন থেকে আগাম সতর্কতা জারি হিসেবে বলা হয়েছিল যে আগামী...

ট্রেনিং বিমান দু’র্ঘটনায় নি’হতদের স্ম’রণে শ্রীনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের দোয়া মাহফিল

শরিফুল খান প্লাবন: শ্রীনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ট্রেনিং ফাইটার বিমান বিধ্বস্ত...

রামনগর ইউনিয়নে ১৭০টি ভাতা বই বিতরণ এজেন্ট ব্যাংকের বি’রুদ্ধে অর্থ কাটার অ’ভিযোগ

মোঃ ওয়াজেদ আলী, স্টাফ রিপোর্টার: যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়ন পরিষদে মোট ১৭০টি ভাতা বই বিতরণ করা হয়েছে। এর...