স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোর:
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা আজ উদযাপিত হচ্ছে। বিদ্যা, সঙ্গীত ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আরাধনায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা মেতে উঠেছে উৎসবে।
শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী, মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এবছর পঞ্চমী তিথি গতকাল ২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২:৩৪ মিনিটে শুরু হয়ে আজ ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯:৫৯ মিনিট পর্যন্ত ছিল। যদিও পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জায়গায় আজ সরকারিভাবে পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
সরস্বতী মূলত এক বৈদিক দেবী। প্রাচীনকালে তিনি নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজিত হতেন। "সরস" শব্দের অর্থ জল, আর "সরস্বতী" শব্দের অর্থ জলবতী। পণ্ডিতদের মতে, তিনি প্রথমে নদী হিসেবে পূজিত হলেও পরে বিদ্যার দেবী রূপে স্বীকৃতি পান। সময়ের সাথে সাথে তাঁর নদীর দেবী রূপ বিলুপ্ত হয়ে তিনি বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত। অতীতে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতীর মতো দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালাগুলোতে শুক্লপঞ্চমী তিথিতে দোয়াত-কলম ও তালপাতার বই রেখে পূজা করার প্রচলন ছিল। পরে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরস্বতী পূজা আয়োজনের প্রথা চালু হয়।
বর্তমানে সরস্বতী সাধারণত দ্বিভুজা রূপে পূজিত হন। তাঁর এক হাতে বীণা (সংগীত ও কলাবিদ্যার প্রতীক) এবং অন্য হাতে জপমালা (আধ্যাত্মবিদ্যার প্রতীক) থাকে। তাঁর সাথে থাকা শুকপাখি বিদ্যার প্রতীক।
সরস্বতী পূজার জন্য কিছু বিশেষ উপাচার ব্যবহৃত হয়, যেমন— অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম, যবের শিষ ও বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল। পূজার দিন কুল খাওয়া নিষিদ্ধ, এবং পূজার আগে কিছু লেখালেখিও নিষিদ্ধ থাকে।
সরস্বতী পূজার সময় উচ্চারিত হয় বিশেষ মন্ত্র—
“ভদ্রকাল্যৈ নম নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ
বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এবচ।”
এর অর্থ— "হে ভদ্রকালী, তোমাকে প্রতিনিয়ত নমস্কার করি। হে সরস্বতী, তোমাকে বারবার নমস্কার করি। বেদ, বেদাঙ্গ ও বেদান্ত যেন আমার বিদ্যাস্থানে অধিষ্ঠিত থাকে।"
পূজার মূল উদ্দেশ্য শুধু জাগতিক বিদ্যা অর্জন নয়, বরং কৃষ্ণভক্তিরূপ জ্ঞান লাভ করা এবং অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা করা।
উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, নেপাল ও বাংলাদেশে সরস্বতী পূজা বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়ি ও সার্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। পূজান্তে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা দলবদ্ধভাবে উপস্থিত হয়। অনেক হিন্দু পরিবারে শিশুদের হাতেখড়ি, ব্রাহ্মণভোজন ও পিতৃতর্পণের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পূজামণ্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
পূজার পরদিন শীতলষষ্ঠী হিসেবে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে কিছু পরিবারে অরন্ধন প্রথা (পূজার পরদিন রান্না না করা) প্রচলিত রয়েছে। দধিকর্মা নামে এক বিশেষ খাবার (চিড়ে ও দই মিশ্রিত) নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যায় সরস্বতী প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া হয়।
সরস্বতী পূজা শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উৎসব। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আনন্দ ও ভক্তির এক মিলনমেলায় পরিণত হয়।