দিরাই প্রতিনিধিঃ
(সুনামগঞ্জ)শাল্লায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালাম হাওর ভাতার জন্য শিক্ষক প্রতি এক হাজার ২শ' টাকা করে উপজেলার পাঁচ শতাধিক শিক্ষকের থেকে কাছ থেকে প্রায় ৭ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। এই কর্মকর্তার পূর্বের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় আতঙ্কিত শাল্লা উপজেলার শিক্ষকরা। তাদের অভিযোগ শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই বিপদ; নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৪ সেপ্টম্বর উপজেলার আগুয়াই সপ্রাবির শিক্ষিকা অঞ্জলি রাণী দাস অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম বেতনসহ দুর্গা পূজার বোনাস বন্ধ করে দেন। অঞ্জলি রাণী দাসের বেতন ও বোনাস তুলতে ২৮ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে শিক্ষা অফিসারকে। এ সময় অঞ্জলি রাণী দাস তার মোবাইল ফোনে এসব রেকর্ড করে রাখেন। কিন্তু ২৮ হাজার টাকা ঘুষ দেওয়ার পরও তার বেতন আটকে রাখা হয়। পরে ওই শিক্ষিকার স্বামী তন্ময় দেব ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর তৎকালীন ইউএনও মো. আবু তালেবের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের ভিত্তিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। গত বছরের ৮ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা দেন ইউএনও। কিন্তু এই ঘুষ গ্রহণের ঘটনায় অন্য কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র ২৮ হাজার টাকা ফেরত দেয়া হয় শিক্ষিকা অঞ্জলি রাণী দাসকে।
এ বিষয়ে ওই শিক্ষিকার স্বামী তন্ময় দেব বলেন, ‘২৮ হাজার টাকা ফেরত পেয়েছি। তবে আর কিছু হয়েছে বলে আমি জানি না। ২০২৪ সালের ১৩ মে অঞ্জলি রাণী দাস মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান।’
শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী বলেন, ‘স্যার কিছু ডরায় না। এই কথা তিনি শিক্ষকদের কাছে কয়। স্যার সরাসরি শিক্ষকদের বদলিতে টাকা খায়। একেক জনের কাছ থেকে ২ লাখ থেকে ৩ লাখ কইরাও টাকা নেয়। এক দপ্তরির চাকুরিতে প্যাঁচ লাগাইয়া ৩ লাখ খাইছে। এক বছরই অর্ধকোটি টাকার বেশি খাইছে। উপজেলার দু'জন শিক্ষক রয়েছেন এসবের মূল নেতৃত্বে। তাদের কথা মতোই কাজ করেন শিক্ষা অফিসার। এমনই তথ্য জানালেন উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মচারি।
ভুক্তভোগী এক শিক্ষক বলেন, গত এপ্রিল মাসে আমি বদলি হয়েছি। বদলিতে শিক্ষা অফিসারকে কোনো টাকা দিয়েছেন কিনা-এমন প্রশ্নে ওই শিক্ষক বলেন না না কোনো টাকা দিতে হয়নি। বদলি তো এখন অনলাইনে হয়। আপনি শিক্ষক হয়ে মিথ্যা কথা বলছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যদি সত্যি কথা বলি তাহলে আমার সমস্যা হবে। তাই সত্যি কথা বলতে চাইলেও পারিনা!
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বদলির পূর্বে শিক্ষা অফিসারকে দিয়েছি ৫০ হাজার টাকা, যোগদানের সময় দিয়েছি ২৫ হাজার টাকা। পরে আরও ১৮ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। শুধু আমি কেনো সবাইকেই টাকা দিতে হয় শিক্ষা অফিসারকে। ওই শিক্ষক আরও বলেন, লোকটি শিক্ষা অফিসার তো নয় যেনো ঘুষের মাস্টার’।
আরেক শিক্ষক বলেন, শুধু বদলিতেই তার ঘুষ খাওয়া সীমাবদ্ধ নয় তার। শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামকে ক্ষুদ্র মেরামত কাজে লাখে ২০-২৫হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। স্লি-পেও টেন পার্সেন্ট দিতে হয়। হাওর ভাতা পেতেও প্রত্যেক শিক্ষকের নিকট থেকে ১২শ' টাকা নিয়েছেন তিনি। আরেক শিক্ষক বলেন ৩ বছর পরপর শান্তি বিনোদন ভাতা দেয় সরকার। সেই ভাতা থেকেও ৫শ' টাকা দিতে হয়। টাইমস্কেলও টাকা দিতে হয় শিক্ষা অফিসারকে। তিনি ঘুষ খেতে উস্তাদ। তার এই ঘুষ বাণিজ্যের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন উপজেলার শিক্ষকরা।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি হেমন্ত কুমার সরকার বলেন, ‘শিক্ষা অফিসারের এসব অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ করতে হবে, আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই তাদের দুর্নীতি বন্ধ হবে।’
নানা অনিয়-দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে আব্দুস সালামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও ফোন রিসিভ করেননি তিনি। তারপর নিজেই ফোন করে পরিচয় জানতে চান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে কিছুই বলতে চাননি তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘দেখুন এ ধরণের দুর্নীতি যদি হয়ে থাকে তাহলে আপনারা পত্রিকায় লিখুন বা ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। তার বিরুদ্ধে আগেও মন্ত্রণালয় শাস্তি দিয়েছে।’
এই বিষয়ে সুনামগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ ড. জয়া সেনগুপ্তা বলেন, ‘আমি কিছুদিনের মধ্যেই শাল্লায় যাব। শিক্ষা অফিসারের দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে তখন কথা বলবেন বলে জানান তিনি।’