সোহেল রানাঃ
‘‘ঠুঙা আইনে দে দড়া আইনে দে বাইল ধারা খান কই, ঠিলের গলাই কাঁনাচ লাগা বেলা গেল ওই, বালির চুনো আগাই আনোই দে দাও ধারা দেবো, ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাব” আবহমান গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এ আঞ্চলিক গানের কথায় গাছির ব্যস্ততা এখন বাস্তবে লক্ষ করা যাচ্ছে যশোরের শার্শার গাছিদের মধ্যে।
যশোরের যশ খেজুরের রস শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তবেও রয়েছে এর সুনাম। শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। বিগত বছরের ন্যায় এ বছর ও শার্শা অঞ্চলের গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস আহরনের জন্য এখন খেজুর গাছের প্রাথমিক পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরপর চাছ দিয়ে নলি, গুজা লাগানোর তিন স্তর পার করে গাছ থেকে রস আহরণ করবেন।
সব মিলিয়ে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষের সুমধুর রসের ঘ্রান আর কিছু দিন পর এ জনপদের গাছিদের ঘরে ঘরে মাতিয়ে তুলতে শুরু করবে।
প্রতিটি ঘরে ঘরে খেজুরের রস ,গুড় ও পাটালি, দিয়ে পিঠা,পায়েস,নাড়ু ,মুড়ি-মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরীর ধুম পড়বে। খেজুরের রস ও রসে ভেজা কাচি পোড়া পিঠার (চিতই পিঠা) সকালে রোদে বসে খাবার স্বাদই আলাদা। নলেন গুড়, ঝোলা গুড় ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধেক পেট ভরে যায়।
যশোরের নলেনগুড়, পাটালির রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস, প্রাচীন কাল থেকেই এ আঞ্চলের গুড় পাটালি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনামের সাথে রপ্তানি করা সহ রস থেকে চিনি উৎপাদন করা হতো। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক যুগ ধরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে আধুনিক সময়ে প্রাকৃতিক নিয়মে মাঠে গড়ে উঠা খেজুর গাছ নির্বিচারে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার ফলে এমনটি হয়েছে।
দিন দিন খেজুর গাছের বাগান এভাবে ধ্বংস হওয়ায় বহুলাংশে কমে গেছে এ অঞ্চলের গুড় পাটালির উৎপাদন। তাছাড়াও নতুন গাছির সংখ্যা ও খেজুর বাগান সৃষ্টি না হওয়ায় এ পেশায় ধ্বস নামছে। এখন সঠিক নলেন গুড়, পাটালি পাওয়া দুষ্কর। যা পাওয়া যায় তাও আবার ভেজালে ভরপুর।উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা চাছা করার জন্য গাছি দা, দড়ি তৈরী সহ ভাড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো (বান) স্থান ঠিক করা সহ বিভিন্ন কাজে রয়েছে মহাব্যস্ত।
কথা হয় ডিহি ইউনিয়নের বেলতা গ্রামের আনারুল ইসলাম,টেংরালী গ্রামের মোহাম্মদ আলী, কাশিপুর গ্রামের আমিনুর রহমান, মোফাজ্জেল হোসেন ও মিজানুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন গাছির সাথে। গাছিরা জানান, এ মৌসূমে অন্যান্য বছরের তুলনায় গাছ কাটা, রস জ্বালানো ও গুড় পাটালি তৈরীর উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গুড়-পাটালির দাম বেশি হবে। গাছি ও গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এমনটি হবে।
গত বছর প্রতি ভাড় রস ১৫০ টাকা, গুড় কেজি প্রতি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা ও পাটালি ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এ বছর রস প্রতি ভাড় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, গুড় কেজি প্রতি ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা এবং পাটালি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। স্থানীয় মধুবৃক্ষপ্রেমী সচেতন মহলের অভিমত, এ অঞ্চলের খেজুর গাছ ও গাছির সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রাচীন গৌরব আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের বন বিভাগ তথা সমন্বিত ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।