অনলাইন ডেস্কঃ
বহুল আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমদ হত্যা মামলার দুই আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) রাত ১০টা ১ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুই আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর ছিলেন অধ্যাপক তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকার। আর মহিউদ্দিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে তাহেরের সহকর্মী। গবেষণাকর্মে জালিয়াতির কারণে মহিউদ্দিনের পদোন্নতি আটকে দিয়েছিলেন তাহের। সেই ক্ষোভে মহিউদ্দিনের পরিকল্পনায় ২০০৬ সালে তাহেরকে হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয়।
আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে আইনজীবী সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, 'সত্যের জয় হল। ধন্যবাদ আপনাদের। সবাইকে কৃতজ্ঞতা।'
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, একই মঞ্চে রাত ১০টা ১ মিনিটে একসঙ্গে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আগেই প্রস্তুত ছিল ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি কার্যকর করতে আটজন জল্লাদের একটি টিমকে প্রশিক্ষণ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
গত বুধবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত কয়েক দফায় শেষ করা হয় ফাঁসির চূড়ান্ত মহড়া। ফাঁসি কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ আলমগীরসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় জল্লাদ নজরুল, সুমন, উজ্জল, মজনু, নাসির, আশরাফুল ও রিয়াজুল নামের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে। এরমধ্যে প্রধান জল্লাদ আলমগীরের বেশ কয়েকটি ফাঁসি দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একেবারে নতুন জল্লাদের খাতায় নাম লিখেছেন রাজশাহীর বহুল আলোচিত রাজশাহীর পুঠিয়ার মহিমা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি উজ্জল। আরেক নতুন জল্লাদ হলেন রিয়াজুল। এছাড়া বাকি ৫ জল্লাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাত ৯টার দিকে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি দুই আসামিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল। তিনি এ সময় মামলার শুরু থেকে শেষ রায় পর্যন্ত আসামিদের পড়ে শোনান। এর পর তাদের গোসল করিয়ে খাবারের বিষয়ে শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়। পরে ফাঁসি কার্যকরের আগে দুই আসামিকে তওবা পড়ান কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম। এর পর ১০টার আগেই আসামিদের ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একই মঞ্চে এক সঙ্গে একই সময় দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রাত ১০টা ১ মিনিট থেকে ১০টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আসামিদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর পর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে পাঠানোর উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সে করে জাহাঙ্গীরের লাশ রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানার খোঁজাপুর গ্রামে এবং মহিউদ্দিনের লাশ ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
ফাঁসি কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী অঞ্চলের ডিআইজি (প্রিজন্স) কামাল হোসেন, জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল, কারাগারের দুইজন চিকিৎসক ও জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। আগে থেকেই কারাগারে প্রস্তুত রাখা হয় লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স। এছাড়াও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
এর আগে গত ২৫ জুলাই দুই আসামির পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। মো. জাহাঙ্গীরের পরিবারের ৩৫ সদস্য তার সঙ্গে দেখা করেন। এছাড়া মিয়া মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের ৫ সদস্য। এরপর তাদের পরিবারের আর কেউ দেখা করতে পারেননি।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমদ। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। দুইদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারি বাসার পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় ড. এস তাহেরের মরদেহ। এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যাপক তাহেরের করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) সূত্র ধরে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, ড. তাহেরের কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক ড. এস তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মো. মহিউদ্দিন এই হত্যার পরিকল্পনা করেন। বালিশ চাপায় খুনের পর অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ বাড়ির পেছনে নেওয়া হয়। মরদেহ গুমের জন্য জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ড. তাহেরের মরদেহ ফেলে দেওয়া হয়।
এরপর ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুইজনকে খালাস দেন। দন্ডিতরা হলেন সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. এস তাহেরের কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সমন্ধি আব্দুস সালাম।
খালাসপ্রাপ্ত চার্জশীটভুক্ত দুই আসামি হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও জাহাঙ্গীরের পিতা আজিম উদ্দিন মুন্সী। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে যায়। পাশাপাশি আসামিরা নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামি মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অপর দুই আসামির (নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সমন্ধি আব্দুস সালাম) দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন হাইকোর্ট।
এরপর আবারও রিভিউ আবেদন করেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম। এরপর গত বছরের ২ মার্চ এই হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি এবং অপর দুই আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখে আসামিদের রায় রিভিউয়ের আবেদন খারিজ করে দেন আপীল বিভাগের ফুল বেঞ্চ। ফলে এর পর প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। এরপরও দণ্ডিত আসামিদের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন স্বজনরা। কিন্তু সেই আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ। মূলত এরপরই কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। তবে রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। গত ৫ জুলাই সেই চিঠি রাজশাহী কারাগারে পৌঁছায়। পরে থেকে তাদের ফাঁসি কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু হয়।