মেরুদণ্ড জোড়া শিশু নূহা-নাবা আলাদা হয়ে বাড়ি ফিরলেন

লেখক: Rakib hossain
প্রকাশ: 3 hours ago

মো. বেল্লাল হাওলাদার:

কুড়িগ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের নাসরিন আক্তারের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে পিঠের নিম্নাংশে মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো অবস্থায় ফুটফুটে দুই বোন নুহা ও নাবা। তাদের শরীরের পেছন ও নিচের দিকে থেকে যুক্ত ছিল তারা। তাদের জন্মের পরপরই বিএসএমএমইউর প্রখ্যাত নিউরোসার্জনস ডা. মোহাম্মদ হোসেন কুড়িগ্রামে গেলে সেখানকার চিকিৎসকরা মেরুদণ্ড জোড়া লাগা এই শিশুদের বিষয়ে তাঁকে জানালে তিনি শিশু দুটিকে দেখতে যান। পরে শিশুদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে আসতে বলেন। ১৪ দিন বয়সের শিশু দুটির মা-বাবা তাদের ঢাকাতে নিয়ে আসলে বিএসএমএমইউর প্রখ্যাত নিউরোসার্জনস ও স্পাইনাল নিউরোসার্জারি ডিভিশন প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে বিএসএমএমইউ-তে অস্ত্রোপচারের মধ্যমে তাদের দুজনের শরীর আলাদা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পরে চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রখ্যাত নিউরোসার্জনস অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে ৩৯ সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল নূহা নাবার আলাদা করার অপারেশনটি সম্পূর্ণ করেন। এই বিশেষজ্ঞ টিমে নিউরোসার্জন, প্লাস্টিক সার্জন, পেডিয়াট্রিক সার্জন, পেডিয়াট্রিক মেডিসিন, ভাসকুলার সার্জন, হেমাটোলজিসহ ৩৯ সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল অংশগ্রহণ করেন।

সফল অস্ত্রোপচারের পর থেকে নূহা ও নাবা আলাদা দুই শিশু এখন। দুজনের পায়খানার পথও এক ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এদের বলা হয় ‘কনজয়েন্ট টুইন পিগোপেগাস’। এ ধরনের জোড়া শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা দেশে এই প্রথম বলেই বলছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা।

বিএসএমএমইউর শুরুতে ওয়ার্ডে, পরে ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে বেড়ে উঠেছে তারা। এখানেই হাঁটতে শিখেছে। কথাও বলতে শিখেছে। তারা এই কেবিনকেই নিজেদের বাড়ি মনে করত। সোমবার (২৫ নভেম্বর) ২ বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে নূহা-নাবা হাসপাতালের ‘বাড়ি’ ছেড়ে প্রজাপতির মতো ঝালর লাগানো একই রকমের হলুদ জামা ও পায়ে গোলাপি জুতা পড়ে
কুড়িগ্রামে নিজেদের বাড়ি ফিরছে।

নুহা নাবার সফল অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেওয়া প্রখ্যাত নিউরোসার্জনস ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমার অধীনে চিকিৎসাধীন নূহা ও নাবা ‘অবশেষে এই দুই শিশু হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে, এটাই আমাদের সফলতা। মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো থাকায় স্পাইনাল কর্ড আলাদা করাটাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি জানালেন, আরেকটি অস্ত্রোপচার করা হবে।

বিএসএমএমইউর সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, এই দুই শিশু জোড়া লাগানো অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। আজ একজন মায়ের কোলে আরেকজন বাবার কোলে চড়ে বাড়ি যাচ্ছে।

এ পর্যন্ত এদের চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৫১ লাখ টাকা। ১৫ লাখ টাকা অনুদান ছাড়া বাকি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করেছে। পরবর্তী চিকিৎসাতেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিশুদের পাশে থাকবে।

সোমবার সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালের কেবিন ব্লকের ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি পাল্টানোর মতো জিনিসপত্র সব বস্তায় ভরা হয়েছে। নূহা ও নাবা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই হাত ধরে দুই বোন হাঁটে তো একটু পরই মারামারি লাগে। একজন বাবার কোলে চড়লে অন্যজনও একই বায়না করে। তবে আগে যে বাবার কোল দখল করেছে, সে কিছুতেই সেখানে বোনকে ভাগ বসাতে দেবে না। নূহা তুলনামূলকভাবে শারীরিকভাবে বেশি সুস্থ, তাই সে বেশি হাসে। নাম জানতে চাইলে দুজনেরই দাবি তাদের নাম ‘নাবা’।

নূহা আর নাবা আনন্দে মেতে থাকলেও তাদের বাবা মো. আলমগীর হোসেন এবং মা নাসরিন আক্তার তেমনভাবে হাসতে পারছেন না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাঁরা যাত্রা করছেন। পরিবহনশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন আলমগীর হোসেন। হাসপাতালে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে হয়েছে বলে চাকরিটা চলে গেছে। এখন বেকার।

২৬ শতক জমি বন্ধক রাখতে হয়েছে। জমি বন্ধকের দুই লাখ টাকা আর চার লাখ টাকা ঋণসহ মোট ৬ লাখ টাকার ধাক্কা। বাড়ি ফিরলেই এ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। ১১ বছর বয়সী ছেলে নাফিউ হোসাইন পড়াশোনায় এক বছর পিছিয়ে গেছে। এখন সে পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। এ পর্যন্ত মেয়েদের ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় আটটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও একটি বাকি আছে।

নূহা-নাবার মা নাসরিন আক্তার বলেন, মেয়েরা আলাদা হবে, এটা তো চিন্তাতেই ছিল না। মেয়েদের হাত ধরে আজ বাড়ি যাচ্ছি, চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। প্রায় ৩২ মাস ধরে মেয়েরা জানত, এটাই তাদের বাড়ি। হাসপাতালের বাইরে তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে রমনা পার্ক আর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেছি। প্রথম দিকে বাইরে নিলেই ভয় পেত।’

এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন নাসরিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের পেটের মধ্যে পায়খানার রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে যে ব্যাগটি ব্যবহার করতে হয়, তা কুড়িগ্রামে পাওয়া যায় না। এই ব্যাগ কিনতেই মাসে ১২ হাজার টাকা লাগবে।

এক সপ্তাহ পরপর ব্যাগগুলো পাল্টে দিতে হয়। মেয়েদের বাবার চাকরি নেই। দেনা আছে অনেক। মেয়েদের প্রতিদিন মাংসসহ অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে। কেউ যদি আমাদের মেয়েদের পাশে দাঁড়ান, তাহলে হয়তো আমরা কিছুটা স্বস্তি পাব।

error: Content is protected !!