স্বীকৃতি বিশ্বাসঃ
ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে স্নানের যেমন বিভিন্ন রকম বেদের তথ্য পাওয়া যায় তেমনি স্নানের উপকারিতা সম্পর্কেও বিশদভাবে বর্ণনা পাওয়া যায়।
শাস্ত্র অনুযায়ী স্নান তিন ধরনের। যথাঃ ব্রহ্ম স্নান, দেব স্নান ও ঋষি স্নান।এছাড়াও তিথি,লগ্ন ও ক্ষণ হিসাব করে নির্দিষ্ট জলে, স্থানে ও নিয়মে বিশেষ স্নানের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সকল স্নানের মধ্যে আছে অষ্টমীর স্নান, বেরুনীর স্নান, কুম্ভর স্নান ও মকরক্রান্তির স্নান ইত্যাদি।
আহত তেমনই একটি মহিমান্বিত ও উল্লেখযোগ্য স্নানের কথা বলছি যা শুধু বাংলাদেশেই শুধু নয় ভারতবর্ষেও বিশেষ সমাদৃত তাহলো নারায়নগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের মহাষ্টমী স্নান। লাঙ্গলবন্দের মহাষ্টমী স্নান সম্পর্কে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে।
ত্রেতাযুগের প্রথম দিকে মগধদেশে ভাগীরথী নদীর কৌশিকী তীরে ভোজকোট নামক নগরীর অধিপতি ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজর্ষি গাধি। রাজর্ষি গাধির বিশ্বামিত্র নামে এক পুত্র ও সত্যবতী নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। সত্যবতীর বিবাহ হয় ভৃগুমুনি নামে পরিচিত ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণকুমার রিচিকের সাথে। সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক মুনির জন্ম হয়। জমদগ্নি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে প্রসেনজিৎ রাজার কন্যা রেণুকাকে বিবাহ করেন। রেণুকার গর্ভে জমদগ্নির পাঁচটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরাম ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। জন্মলগ্নে এই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল রাম। ইনি কুঠার দ্বারা একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেন।
কুঠার ধারণের জন্য তার নাম পরশুরাম (কুঠারধারী রাম ) রূপে খ্যাত হয়। ভৃগুবংশের সন্তান – এজন্য তাকে ভার্গব এবং জমদগ্নির পুত্র বলে তাকে জমদগ্ন্য নামেও সম্বোধন করা হয়। একদিন জমদগ্নির পাঁচপুত্র ফল সংগ্রহের জন্য বনে গেলে তাদের মাতা অমোঘাদেবী (রেণুকাদেবী) স্নানপূর্বক পানীয় জল আনয়নের জন্য নিকটস্থ গঙ্গানদীতে যান। তিনি যখন নদীর ঘাটে জল আনতে যান তখন শতবাহু নামে এক রাজা তাঁর শত -স্ত্রী সনে গঙ্গা নদীতে জলকেলি করছিলেন। রাজা তাঁর শতবাহুতে নদীর জল আকর্ষণ করলে অবলীলাক্রমে স্ত্রীগণ তাঁর বাহুর মধ্যে অনুপ্রবেশ করেন। হঠাৎ রাজা সমস্ত জল একবারে ছেড়ে দেন। স্ত্রীগণ তীব্র স্রোতে ভেসে যেতে থাকলে রাজা পূনর্বার জল আকর্ষণ করেন। এমত জলকেলি চলাকালে জমদগ্নি ঋষি-পত্নী অমোঘা দেবী (রেণুকাদেবী ) নদীর ঘাটে গিয়ে শতবাহু রাজার কৌতুকপূর্ণ নয়নাভিরাম জলকেলি দর্শনে অন্তরে এক বিচিত্র পুলক অনুভব করেন। কিছুক্ষণ এ দৃশ্য দর্শনান্তে জল নিয়ে ঘরে ফিরলে ঋষি জমদগ্নি স্ত্রীর বিলম্ব ও শরীর রোমাঞ্চিত হবার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু অমোঘা দেবীকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি যোগবলে পত্নীর পূর্বাপর সকল ঘটনা অবগত হন। ঋষি স্ত্রীর এই বিধ মানসিক বিকৃতিতে ক্রোধাম্বিত হয়ে পড়েন। রূঢ়স্বরে তৎক্ষণাৎ স্বীয় পুত্রদেরকে তাদের মাতাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ চার পুত্রই মাতাকে হত্যা করতে অস্বীকার করেন-পিতার আদেশ অমান্য করেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে চার পুত্রকেই পশু – পক্ষীর মত জড় ও হীনবুদ্ধিসম্পন্ন নিকৃষ্ট জীবন প্রাপ্তির অভিশাপ দেন।
সর্বশেষ তিনি তাঁর পঞ্চম পুত্র রামকে মাতৃ হত্যার আদেশ দেন। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার মহামুনি ভৃগুর প্রপৌত্র পরশুরাম (জমদগ্নি) কম্পিত হৃদয়ে শঙ্কিত চিত্তে পিতৃ আজ্ঞা সম্পন্ন করেন। পিতৃআজ্ঞা পালন করার আশীর্বাদস্বরূপ জমিদগ্নি ঋষি পরশুরামকে বর চাইতে বললেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয় পরশুরাম আবেগাপ্লুত কণ্ঠে (৪) চারটি বর চাইলেন-
(১ ) তপঃপ্রভাবে আমাদের মা যেন আবার জীবিত হয়ে আমাদের সাথে বসবাস করেন,(২ ) হত্যার ঘটনা যেন মায়ের স্মরণে না থাকে,(৩ ) জ্যেষ্ঠভ্রাতাগণ যেন মনুষ্যবৎ পূর্বাবস্থা ফিরে পান,(৪ ) এই হতাকান্ডে তাঁর যেন পাপস্পর্শ না হয়।
কিন্তু যেইমাত্র মাতার দেহ কুঠারে দ্বিখন্ডিত হয়েছে সেই মুহুর্তেই পরশুরাম মাতৃহত্যা ও নারী হত্যাজনিত দ্বিবিধ পাপে আক্রান্ত হলেন। পরশুরাম হতবাক। – একি! তাঁর তাহের কুঠার যে হাতেই লেগে আছে। তিনি উদ্বিগ্নাকুলচিত্তে পিতৃদেবকে জিজ্ঞেস করলেন- পিতা ! আমিতো আজ্ঞাবহ- মাত্র, তবে কেন কুঠার আমার হাতে লেগে আছে?
পিতা বললেন- ‘ তুমি মাতৃহত্যা আর নারীহত্যা দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছো। আর জেনে রেখো , পাপ ছোট বা বড় যা – ই হোক না কেন , কৃতকর্মীকে তা’ স্পর্শ করবেই। ঋষি পুত্রকে আশ্বস্ত করে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। আর উদ্বিগ্ন না হয়ে অবিলম্বে সর্বতীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে বললেন- ‘ যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে , জানবে যে ঐ পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। পিতৃ আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে জামদগ্ন্য ( পরশুরাম) পৃথিবী পর্যটনে বের হয়ে নানা তীর্থ পরিভ্রমন করতে লাগলেন। অবশেষে একদিন তিনি হিমালয় পর্বতের উত্তর -পূর্ব কোণে , মানস সরোবরের সন্নিকটে এক বৃহৎ কুপ সমীপে উপনীত হলেন। এবং পরমেশ্বরকে স্মরণ করে পরশুরাম ব্রহ্মকুন্ডে অবগাহন করলেন। অবগাহন করার সাথে সাথে তার হাতে লেগে থাকা কুঠারখানা স্খলিত হয়ে গেল , তিনি সর্ববিধ পাপ থেকে অব্যাহতি পেলেন আর মহাপাপ থেকে মুক্তি লাভ করলেন । পরশুরাম মনে মনে স্থির করলেন- এমন সুমহান পুণ্যজল (সলিল ) যা আমাকে মহাপাপ থেকে মুক্ত করেছে সেই পুণ্যজল সর্বসাধারণের নিত্য সহজলভ্য করার জন্য এর ধারা পৃথিবীতে প্রবাহিত করব। ত্রেতাযুগে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থানুযায়ী নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে কোন না কোন আশ্রম নিবাসী থাকতে হতো।
এসব আশ্রমে (গোত্রে ) মুনি ঋষিগণ লেখাপড়া থেকে আরম্ভ করে গৃহকর্ম , কৃষিকার্য , রাজনীতি, ধর্মনীতি , সমাজনীতি , যুদ্ধনীতি , অর্থনীতি ও গার্হস্থ্য নীতি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। আশ্রমের আওতাধীন সম্পত্তিতে উৎপাদিত ফসলের দ্বারা আশ্রমবাসীদের জীবিকা ও সমস্ত ব্যয় ভার স্বচ্ছন্দে নির্বাহ হতো। সে ধারাবাহিকতায় পরশুরাম হাল কর্ষণ করতেন পিতার আশ্রমে। তাই আশ্রম থেকে হাতে কুঠার এবং হাল নিয়ে পিতৃ আজ্ঞায় বহির্গত হন। কুঠার হস্তচালিত হলে হাল দিয়ে কঠিন পাথরের বক্ষ বিদীর্ণ করে ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে হিমালয়ের পাদদেশে সমভূমিতে আনতে সক্ষম হন। তারপর উক্ত কর্ষণের লাঙ্গল দিয়ে মাটি চষে নিয়ে ক্রমাগত চলতে চলতে ব্রহ্।