মিশকাতুজ্জামান নড়াইল:
সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে একসময় কাজের সন্ধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটেছেন বেকার তরুণ সাদ্দাম হোসেন (৩৪)। কোনো উপান্তর না পেয়ে খুলনা গিয়ে শুরু করেন সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ (বিক্রয় প্রতিনিধি) বা এস আর চাকরি। এরপর সিকিউরিটি গার্ড। বেতন পেতেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। ২০১০ সালের দিকে বিবাহিত জীবনে এ বেতনে সংসারে টানাপড়েন ছিল তার। জীবন-জীবিকার তাগিদে সামান্য বেতনের চাকরি ছেড়ে সাতক্ষীরা গিয়ে শুরু করেন রাজমিস্ত্রির কাজ। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে যে পারিশ্রমিক পেতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। একসময় পূর্ণমিস্ত্রি হয়ে উঠেন। প্রায় পাঁচ বছর করেন এ কাজ।
রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে সাদ্দাম একটি মাধ্যমে জানতে পারেন-অনলাইনে কাজের খবর। রাজমিস্ত্রির কাজের ফাঁকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়েন অনলাইন প্লাটফর্মে। অল্পদিনের ব্যবধানে হয়ে উঠেন সফল ফ্রিল্যান্সার ও ইউটিউবার। সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সাদ্দাম হোসেনের। রাজমিন্ত্রি থেকে হয়েছেন সফল ইউটিউবার ও ফ্রিল্যান্সার। উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেলেও অনলাইন প্লাটফর্মে সফল মানুষ তিনি। সাদ্দাম হোসেন তার সফলতার গল্প বলতে গিয়ে বলেন, জীবন সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছি। তবে হাল ছাড়িনি। অনেক কষ্টের মাঝেও সফলতার মুখ দেখেছি। এস আর থেকে শুরু করে সিকিউরিটি গার্ড এবং রাজমিস্ত্রির কাজ করেছি। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী বেতন পাইনি। তাই অনলাইন মাধ্যম বেছে নিয়েছি। অবশেষে সফলও হয়েছি।
অনলাইনে কাজে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সাদ্দাম বলেন, ফ্রিল্যান্সার বা অনলাইন মার্কেট পেসের কাজটি শুরু করেছি ২০১৩ সাল থেকে। তবে প্রথমে কাজ শেখার জন্য ভালো কোনো শিক্ষক পাইনি। তবে হাল ছাড়িনি। ‘ওয়েব ডিজাইন’ দিয়ে অনলাইন জগতে প্রথমে কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে ইউটিউব চ্যানেল, ফেইসবুক পেজসহ ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন ধরণের কাজ করছি। সবমিলে প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় হচ্ছে। তবে ২০১৮ সালে এক মাসে ১৮ লাখ পর্যন্ত আয়ের রেকর্ড আছে। সম্প্রতি ‘বিগাজু’ ওয়েবসাইট করে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্যও তৈরি করেছেন-যঃঃঢ়ং://ভৎববষধহপরহমরঃ.পড়স ওয়েবসাইট। অনলাইনের আয়ের ওপর নির্ভর করেই নড়াইল উপশহর সংলগ্ন দলজিতপুর মৌজায় পাঁচ শতক জমির ওপর একতলা পাকাবাড়ি, সাড়ে তিন শতক জমিতে মার্কেটসহ ১২৬ শতক চাষাবাদের জমি কিনেছেন সাদ্দাম হোসেন। সবমিলে জিরো থেকে কোটিপতি হয়েছেন তিনি। ইউটিউব, ফ্রিল্যান্সার, ফেইসবুক পেজসহ অনলাইন মার্কেটিংয়ের পাশাপাশি এসব বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন সাদ্দাম হোসেন। সরাসরি ও অনলাইনে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেনের ক্লাস করে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্সার ও ইউটিউবার।
সাদ্দাম হোসেনের শিক্ষার্থী নড়াইলের দলজিতপুরের মেহেদী, শাকিব, রাজশাহী জেলার রফিকুল ইসলাম ও ময়মনসিংহের আমিনুল ইসলামসহ অনেকে বলেন, সাদ্দাম স্যারের কাজ থেকে আমরা বিনামূল্যে ক্লাস করে ফ্রিল্যান্সিং জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এখন নিজেরাই দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ভালো উপার্জন করছি। আমরাও এখন অন্যদের ফ্রিল্যান্সিং শেখাচ্ছি।দুর্গাপুর এলাকার জাকির হোসেন বলেন, সাদ্দাম এলাকার ‘ফ্রিল্যান্সার মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি নিজে সফল হয়েছেন। অনলাইন প্লাটফর্মে অন্যদেরও সফল করার লক্ষ্যে সবসময় কাজ করে যাচ্ছেন।
যুবক সাদ্দাম হোসেনের এ কাজে খুশি পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনও। সাদ্দামের স্ত্রী সোনালী হোসেন জানান, তার স্বামীর আয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন তারা। বোন সায়মা আক্তার বলেন, ভাইয়ের আয়ে আমরা সবাই খুশি। এদিকে সাদ্দাম হোসনের সাফল্যের গল্প হতাশাগ্রস্থ বেকারদের অনুপ্রেরণা যোগাতে ২০১৯ সালের বইমেলাতে কনফিডেন্স পাবলিকেশন্স থেকে ‘সিক্স ফিগার সিলভার টিউবার’ শিরোনামে বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইতে সাদ্দাম হোসেনের সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অনলাইন আয়ের ওপর নির্ভর করেই মা-বাবা, দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ ছয়জনের সংসার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে পরিচালনা করছেন সাদ্দাম হোসেন। এলাকার তরুণ ও বেকার যুবকদের ‘মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। চাকরির ওপর শুধু নির্ভরশীল না হয়ে হতাশাগ্রস্থ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে তরুণ প্রজন্মকে অনলাইনভিত্তিক কাজ করার আহবান সফল ফ্রিল্যান্সার ও ইউটিউবার সাদ্দাম হোসেনের। খুলনার কয়রা উপজেলার দুই নম্বর কয়রা গ্রামের এম. আব্দুস সাত্তার ও সায়রা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে সাদ্দাম হোসনে। এছাড়া বড় ভাই ও ছোট দুই বোন রয়েছে। প্রায় তিন বছর আগে নড়াইল উপশহর গারুচিরা বাজারের পাশে দলজিতপুর মৌজায় পাকাবাড়ি করে সপরিবারে বসবাস করছেন সাদ্দাম হোসেন।