মোঃ রাজু, রংপুর বিভাগীয় প্রতিনিধি :
দেশের কৃষি প্রধান জেলা গুলির মধ্যে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও অন্যতম। দেশের মোট উৎপাদিত গমের পাঁচভাগের এক ভাগ গমই উৎপাদন হতো এখানে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে গম রপ্তানি হতো দেশের অভ্যন্তরীণ জেলাসহ বিদেশেও। তবে গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে ধীরে ধীরে কমেছে গম চাষ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যমতে গত ৬ বছরের গম চাষের হিসাব বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায় গম চাষ প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে ঠাকুরগাঁওয়ে।
বিশ্লেষনের হিসাব বলছে ২০১৬-১৭ চাষ মৌসুমে জেলাতে গম চাষ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে, ২০১৭-১৮ চাষ মৌসুমে ৬১ হাজার হেক্টর, ২০১৮-১৯ চাষ মৌসুমে ৫০ হাজার ২২০ হেক্টর, ২০১৯-২০ চাষ মৌসুমে ৫০ হাজার ৬৫০ হেক্টর, ২০২০-২১ চাষ মৌসুমে ৪৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর, ২০২১-২২ চাষ মৌসুমে ৪৫ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়েছিল। সর্বশেষ ২০২২-২৩ চাষ মৌসুমে তা আরও কমেছে। এ বছর গম চাষ হয়েছে ৩১ হাজার ১৫০ হ্টোর জমিতে।
চলতি বছর চাষ মৌসুমে জেলাতে ৪৪ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর৷
কেন গম চাষে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকগণ এমন প্রশ্ন নিয়ে গম চাষে বিমুখ কৃষকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, গমের চেয়ে ভুট্টা ও আলু বেশি উৎপাদন হয়। তাই তারা গমের পরিবর্তে আলু , ভুট্টা ও সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন। এছাড়াও বীজ সংকট, বীজ পেতে ভোগান্তি, বীজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনে চড়া দাম, ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট, সরকারের নির্ধারিত দামে কৃষকদের অখুশি সহ নানা সমস্যা উঠে আসে এসব কৃষকদের মুখ থেকে।
সদর উপজেলার কহরপাড়া গ্রামের কৃষক মনতাজ আলী বলেন, এক বিঘা জমিতে গম উৎপাদন খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ৩০ মনের বেশি গম পাওয়া যায়না। এতে লাভ কম হয়। তাই আলু উত্তোলনের পর পরেই আগাম ভুট্টা চাষ করেছি। ভুট্টাতে একই খরচে বেশি ফলন পাওয়া যায় এবং দামও পাই ভালো।
সদর উপজেলার আরেক কৃষক অঅলম হোসেন বলেন, যেসব জমি আগে গমে ভরে থাকতো সেসব জমিতে এখন ভুট্টা সহ অন্যান্য ফসল ফলাচ্ছে কৃষকরা। আমি এ বছর ৫ বিঘা জমিতে গম আবাদ করছি। বীজ কিনতে যে ভোগান্তিতে পড়েছি তাতে আগামি বছর আর গম চাষের ইচ্ছে হবেনা।
তবে ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট এর সহকারি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনে করেন একজন কৃষক আলু উত্তোলণ করেই জমিতে গম চাষ করতে পারেন।
গম কাটাইয়ের পর ভুট্টা চাষ করতে পারেন এবং একই জমিতে বরো ধান চাষ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একজন কৃষক বেশি লাভবান হতে পারেন। আমরা কৃষকদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করছি এবং বীজ উৎপাদনে তাদের সহযোগিতা করছি৷ তারা যেন নিজেরাই নিজেদের বীজ উৎপাদন করতে পারেন।
জেলা বিএডিসি কার্যালয়ের বীজ বিক্রয় ও বিতরণ কর্মকর্তা এনামুল হক জানান, জেলাতে বিএডিসির ১৬১ জন বীজ পরিবেশক রয়েছেন। যাদেরকে এ বছর ৫৫৭ টন বীজ বরাদ্দ সহ বিএডিসির বুথ থেকে ৪০ টন বীজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
কৃষি অফিসের গম চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বীজের চাহিদা হেক্টর প্রতি ১২০ কেজি হলে ৫ হাজার ৩৬৪ টন বীজ। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে গমের চাষ ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার কারনে খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকগণ। তারা বলছেন, এভাবে গমের চাষ কমে গেলে দেশকে গমে আমদানি নির্ভর হয়ে যেতে হবে। ফলে খাদ্য পণ্যের ব্যপক দাম বাড়বে।
ভুট্টা থেকে বেশিরভাগ গোবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন হয় আর গম থেকে মানুষের খাদ্য উৎপাদন হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিগত বছর গুলোর তুলনায় এখন গমের চাষ কমেছে ঠাকুরগাঁওয়ে। তবে সেসব জমিতে এখন সরিষা ও ভুট্টার চাষ হচ্ছে। জমি ফাঁকা রাখছেন না কৃষকরা। সরিষার পরে কৃষকরা বরো চাষ করবে। কৃষকরা যে আবাদই করুক আমাদের সহযোগিতা থাকবে তবে সময়টা মাথায় রেখে চাষ করলে গম চাষে লাভবান হয়ে আবারো উৎসাহ ফিরে পাবে তারা।