কোটা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ যশোরের জাবিরের মৃত্যু 

লেখক: Rakib hossain
প্রকাশ: 4 months ago

ইমরান হোসেন শার্শা (যশোর) প্রতিনিধিঃ

শোকে স্তব্ধ গোটা এলাকা। স্বজন হারানোর ব্যাথায় চরমভাবে ব্যাথিত এলাকাবাসী। ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি তাজা প্রাণ ছাত্র অধিকারের পক্ষে রাজপথে নেমে লাশ হয়ে ফিরবে সেটা কেউ মেনে নিতে পারছেন না। সন্তানের লাশ পিতার কাঁধে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোঝা – সেই বোঝা কাঁধে করে দুই নয়নের জলে হৃদয় ভাসিয়ে একমাত্র পুত্রের লাশ নিয়ে ফিরছেন ঢাকা মেডিকেল থেকে কৃষক নওশের আলী। সাথে তার স্ত্রী শিরিনা বেগম ও একমাত্র মেয়ে জেরিন রয়েছে। এই পথ যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল মর্গের সামনে হাজারও শোকাহত পরিবারের একটি নওশের আলীর পরিবার। এই পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান ইমতিয়াজ আহমেদ জাবীর। যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন শহীদ।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাজিরবাগ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম দেউলী। এই গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির (২৩) ।

কৃষক নওশের আলী ও গৃহিনী শিরিনা আক্তার দম্পত্তির ২ সন্তানের মধ্যে জাবির বড়। ছোট মেয়ে জেনির স্থানীয় বাগআঁচড়া ডিগ্রি কলেজের আই এ ফাষ্ট ইয়ারের ছাত্র। জাাবির ২০১৮ সালে ডি,এস,টি,হাই স্কুল থেকে জিপিএ৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নাভারণ আকিজ কলিজিয়েটস্কুল এন্ড কলেজে আইএ ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে মানবিক বিভাগের ছাত্র হিসেবে জিপিএ৫ পেয়ে ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। জাবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ২০২১-২২ শিক্ষা বর্ষে ঢাকার সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটিতে বিবিএ কোর্সে ভর্তি হন।

 

 

 

পিতা মাতার স্বপ্ন ছিলো তাদের একমাত্র সন্তান বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে দেশ ও দশের মুখ উজ্জল করবে। পরিবারের হাল ধরবে। কৃষক পিতা নওশের আলী স্বপ্ন দেখতেন তার ছেলে মানুষের মতো মানুষ হয়ে এলাকাবাসীর ও পিতা হিসেবে তার মুখ সে উজ্জল করবে। ছেলের গর্বে পিতার বুক ভরে উঠবে। কিন্তু হায় ! আজ সেই ছেলের লাশ কাঁধে করে ঢাকা থেকে ফিরতে হচ্ছে এক বুক জ্বালা ব্যাথা আর বেদনা নিয়ে।

 

যে সন্তান এক সপ্তাহ আগেও পিতার সাথে ফোনে কথা বলেছিল, কত স্বপ্নের কথা, আশার কথা, ভালোবাসার কথা বলে সে বাবাকে শান্তনা দিয়েছি। জাবির বলেছিল, বাবা ভয় নেই জয় আমাদের হবেই। তোমার ছেলে একা নয় বাবা, দেশের লাখো কোটি পরিবারের ছেলেরা আজ রাজপথে নেমেছে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। লাখো লাখো শিক্ষার্থীর সেই আন্দোলন বৃথা যাবে না বাবা। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ বাবা। দেখো তোমার ছেলের কিছুই হবে না। মাকে কে বলো আমার জন্য দোয়া করতে। আর ছোট বোন জেরিনের দিকে খেয়াল রেখ বাবা। বাবা রাখছি, বন্ধুরা আন্দোলনে যেতে ডাকছে। যাই বাবা , ভালো থেকো। এই পিতা পুত্রের শেষ কথা।

 

আর কোন দিন ছেলে তার বাপকে ডাকবে না। ঢাকা থেকে কোন দিন আর ফোন করে বলবে না বাবা আমার টাকা লাগবে। বই কিনতে হবে। মেসে খাবারের টাকা দিতে হবে। মাকে আর বলবে না , মা আমি বাড়ি আসছি তুমি একটা দেশি মুগরী রান্না করে সিট রুটি বানাও। আমি এসে খাব। আদরের ছোট বোন জেরিনকে আর ধমক দিয়ে পড়ার টেবিলে বসতে বলবে না। তোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে বলে আর কেউ স্বপ্ন দেখাবে না। এক নিশ্বাসে এই কথা গুলো বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন সন্তান হারা পিতা কৃষক নওশের আলী।

 

মোবাইল ফোনে গতকাল শুক্রবার বিকেলে যখন এই প্রতিবেদক নওশের আলীর সাথে কথা বলছিলেন তখন হাজারও মা বাবার সাথে নওশের আলী দম্পত্তি একমাত্র মেয়ে জেরিনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে বসে ছিলেন ছেলের লাশ গ্রহণ করার জন্য।

 

 

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই একটা ঘৃনা ভরা কন্ঠে নওশের আলীর জবাব কেন আপনারা আমাকে বিরক্ত করছেন। এসব গল্প শুনে কি করবেন। আপনাদের মিডিয়ায় তো এসব খবর ছাপা হবে না। আপনারা শুধু আগুনের ছবি, পুড়ানোর ছবি দেখাচ্ছেন। এই যে শত শত সন্তানের লাশ কই কোন মিডিয়ায় তো সে সব খবর, সে সব ছবি দেখাচ্ছেন না। নিজের পরিচয় দিয়ে যশোরের কথা বলে একটু বিনয়ের সাথে নিজেরে অপারগতার কথা বলায় তিনি একটু শান্ত হলেন। তারপর ধিরে ধিরে সন্তানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া শেখা আর সন্তানের সাথে বলা শেষ কথা গুলো এভাবেই শোনালেন পুত্রহারা পিতা।

ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির অত্যন্ত একজন মেধাবী ছাত্র। ছাত্র জীবনে সে কোন ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। কৃষক নওশের আলী বা তার পরিবারের কেউ কোন দিন কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। জাবির নিজেও কোন দিন রাজনীতির পাঠে হাতে খড়ি নেননি। শুধু নিজের অধিকার রক্ষার জন্য, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য দেশে চলমান কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা তথা মেধা পরীক্ষার দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মম বুলেটে শহীদ হলেন মেধাবী ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির।

 

 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করার সময় ১৭ জুলাই সাউথইষ্ট ভার্সিটির ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তায় পুলিশের গুলিতে আহত হন জাবিরসহ তার আরো বহু সহপাঠী। ওই দিনই বিকেলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। শত শত গুলিবিদ্ধ আর আহত শিক্ষার্থীর সাথে জাবিরও চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। মোবাইল ফোনে বার বার ছেলের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন পিতাসহ পরিবারের সদ্যরা। শেষ পর্যন্ত ২৪ জুলাই নওশের আলী জানতে পারেন তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন। খবর পাওয়া মাত্রই একমাত্র মেয়েকে সঙ্গে করে নওশের আলী দম্পত্তি ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান। কিন্তু তাকে ছেলের কাছে যেতে বাঁধা দিয়েছেন পুলিশ ও বিজিরি সদস্যরা। বার বার তিনি ছেলের মুখটি একবার দেখার অনুরোধ করেও ব্যর্থ হয়েছেন। ২ রাত আর একদিন মেডিকেলের গেটে বসে থেকে জাবিরের এক সহপাঠীর সহযোগিতায় যখন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ছেলের কাছে পৌঁছান নওশের দম্পত্তি ততক্ষনে ছেলে কোমায় চলে গেছেন। বার বার ছেলেকে ডেকেও শেষ কথাটি শুনতে পাননি নওশের দম্পত্তি। তারপরও বুকে আশা নিয়ে ছেলের কাছে ছিলেন। কিন্তু আজ শুক্রবার সকালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মেধাবী ছাত্র একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা ভরসার শেষ প্রদীপ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির। একমাত্র পুত্রের লাশ বুকে নিয়ে পিতা মাতা আর বোনের যে কাঁন্না তা ভাষায় প্রকাশের নয়।
অশ্রু সজল নেত্রে নওশের আলী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, ভাই আমার সব শেষ হয়ে গেল। এই পৃথিবীতে আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই। কি হবে এই দেশে বেঁচে থেকে। যে সন্তানকে খুব কষ্ট করে, খেয়ে না খেয়ে বড় করে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম সেই ছেলের লাশ নিয়ে আজ আমাকে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। কি জবাব দেব আমি এলাকাবসীকে। যারা আমার ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো, গর্ব করতো তাদের আমি কি জবাব দেব বলতে পারেন সাংবাদিক সাহেব ?

 

 

এদিকে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর নওশের আলীর গ্রামের বাড়ি ঝিকরগাছার হাজিরবাগ ইউনিয়নের দেউলী গ্রামে গেলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। জাবিরের মৃত্যুর খবরে গোটা গ্রামবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসছে। সকলেই স্তব্ধ। কারোর মুখে যেন কোন ভাষা নেই। সবাই শোকাহত। নওশের আলীর বাড়িতে লোকে লোকারন্য। কখন আসবে তাদের সকলের প্রিয় জাবিরের লাশ সেই আশায় সবাই হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। ন

ওশের আলী বাড়ির উঠোনে কথা হয় হাজিরবাগ ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বর শেখ হুমায়ুন কবিরের সাথে। তিনি এই ওয়ার্ডে পর পর ৩ বার মেম্বরের দায়িত্ব পালন করছেন। পরিচয় দিয়ে মেম্বরের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, এই পরিবারটি খুবই নিরীহ প্রকৃতির। কারোর সাথে এদের কোন ঝগড়াঝাটি বা গন্ডগোল হয়েছে বলে আমার জানা নেই। নওশের আলী খুবই সাদাসিধে মানুষ। সে কৃষি কাজ করে জীবন নির্বাহ করে। কোন দিন কোন রাজনীতির সাথে বা কোন দলাদলির সাথে পাছে সে থাকে না। তার ছেলে মেয়ে দুটোও খুব ভদ্র, নম্র ও পর্দানশীল। তারা কোন দিন কারোর সাথে বেয়াদবি বা খারাপ কোন আচরন করেছে বলে আমার জানান নেই। জাবির যখনই এলাকায় আসতো সকলের সাথে হেসে খেলে কথা বলে সময় কাটাতো।

কথা হয় জাবিরের স্কুল শিক্ষক আশরাফুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, জাবির ও তার বোন দুই জনই আমার ছাত্র ছিলো। তারা খুবই ভদ্র। তাদের কে কোন দিন কোন খারাপ সঙ্গে পাইনি। তারা দুই ভাই বোনই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। জাবির তো সব সময় ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিল। সে আমাদের গর্ব ছিল। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা ছিল যে, সে একদিন বড় কিছু একটা হবে। কিন্তু আজ সবই শেষ। ছাত্র জাবিরের মৃত্যু খবরে তার শিক্ষকরাও মর্মাহত।

এদিকে গোটা গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। গ্রামবাসী সবাই স্তব্ধ, শোকে পাথর প্রায় প্রতিবেশীরা। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরাও শোকাহত। কখন আসবে লাশ সেই আশায় প্রহর গুনছেন শহীদ জাবিরের স্বজনরা।

বিকেলে মোবাইল ফোনে নিহত ইমতিয়াজ আহমেদ জাবিরের পিতা নওশের আলী জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটে বসে আছি। কখন ছেলের লাশ পাবো তাও জানি না। কেউ কোন সহযোগিতা করছে না। মেডিকেল থেকে জানানো হয়েছে, আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে। আমাদের কাছে পুলিশও রয়েছে।

বিকাল পৌনে ৫টায় নওশের আলী জানান, আনুষ্ঠানিকতা শেষে এ্যাম্বুলেন্স করে নিহত সন্তানের লাশ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবেন, তবে কখন তা তিনি জানেন না। নওশের আলীর সাথে তার ছেলের কয়েকজন সহপাঠী ও ২ জন শিক্ষকও রয়েছেন বলে তিনি জানান। এদিকে গ্রামবাসীসহ গোটা এলাকাবাসী এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছন।

error: Content is protected !!