স্বীকৃতি বিশ্বাসঃ
হিন্দুদের আদি দেব দেবাদিদেব মহেশ্বর। সৃষ্টি,স্থিতি ও বিনাশের কর্তা শিবকে উপলক্ষ করে হিন্দুরা লৌকিক ভাটি পুজো উদযাপন করেন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় বৃহত্তর যশোর-খুলনা, বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ ভাটি পুজো করে। মূলত ভাটি অঞ্চলের পুজো বলেই একে ভাটি পুজো বলা হয়।অঞ্চলের গার্হস্থ্য ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্রিয়, বৈশ্য,শূদ্র শ্রেণিভুক্ত নমঃশূদ্র, কাপালি, পুণ্ড্রক্ষত্রিয়, মুণ্ডা, ঋষি, বাগদী,বাইতি, বাওয়ালি, মাওয়াল, মাঝি, ঘোষ, কর্মকার, কুমার, ছুতার, নরসুন্দর প্রভৃতি পেশাজীবী মানুষের মধ্যে ভাটি পূজা হতে দেখা যায়।তবে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পুজোর প্রচলন বেশি।
মানুষেরা নিজেদের বসন্ত,ঘা-পাচড়া ও গৃহপলিত পশুর রোগ বালাই থেকে মুক্তির জন্য এই পূজা পালন করেন।
ভাটিপূজা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পুজো। এই পূজায় শিশু-কিশোর ও বয়ঃজ্যোষ্ঠ নারীদের অংশগ্রহণ বেশি লক্ষ করা গেলেও অনেক সময় পুরুষরাও অংশ গ্রহন করেন।
ভাটিপূজার উপাস্য দেবতা দেবাদিদেব মহাদেব। তবে দেবতার কোন বিগ্রহ থাকে না।হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি জীবের লালনপালন ও ত্রাণকর্তা।তিনি মানুষকে রোগবালাইসহ সকল প্রকার বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখেন।
এই পুজা সাধারণতঃ গ্রামের বারোয়ারি তলায় হয়। গ্রামের থান বা গ্রামের বাইরে কোনো গাছ তলায় এই পুজোর স্থান নির্ধারিত থাকে। একটি গাছকে কেন্দ্র করে এই পুজোর আনুষ্ঠানিকতা লক্ষ করা যায়। বট, পাকুড়, জিয়ল, নীম, কেওড়া প্রভৃতি গাছের নীচে ফাল্গুন সংক্রান্তিতে এই পুজা দেওয়া হয়। ফাল্গুন মাসের শেষ তিন দিন বিভিন্ন আচারের মাধ্যমে ভাটি পুজা শেষ হলেও বাস্তবে চৈত্রমাস ব্যাপি নানা আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকে এবং চৈত্র সংক্রান্তী বা চড়ক পূজার মধ্য দিয়ে শিবের আরাধনা শেষ হয়।
এবছর যশোর জেলার অভয়নগর মনিরামপুর, কেশবপুর উপজেলার ভবদহ অধ্যুষিত এলাকায় গত ১২ মার্চ (২৮ ফাল্গুন) ভাটি পূজা শুরু হয়ে আজ ১৪ মার্চ(৩০ ফাল্গুন) সকালে পূজা ও অঞ্জলি প্রদানের মাধ্যমে পূজার অনুষ্ঠিকতা শেষ হয়েছে।
এর পর বাড়ির পুরুষরা গোয়ালের গরুগুলো পুকুরে নিয়ে গা ধোওয়ানো, ভাঁট পাতা দিয়ে গরুর শরীরকে পরিষ্কার করা,এরপর পূজা থেকে আনা তেল,জল,ফুল দিয়ে গুরুদের পূজা দেওয়া ও সন্ধ্যায় পাড়ার সবাই মিলে মাঙন করা চাল-ডাল-সব্জী দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো কার্যক্রম শেষ হবে।
সকাল বেলা গ্রামের শিশুরা কুলায় করে পূজার বিভিন্ন উপাচার সাজিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম দুইদিন উপাচারের মধ্যে থাকে কেবল নানা প্রকার ফুল। যেমন, ভাঁটফুল, মান্দার ফুল, নীলকণ্ঠ, কল্কে, কাঠগোলাপ, শিয়াল কাটা ইত্যাদি। কুলার উপর বুয়ো (পুইয়ে) গাছের পাতা বিছিয়ে তার উপর ফুল সাজিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থানের গাছকে ঘিরে সকলে তাদের কুলা বৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখে।
বট, পাকুড়, জিয়ল, নীম, কেওড়া প্রভৃতি গাছই ভাটি দেবতার আশ্রয়স্থল বলে স্বীকার করা হয়। এই দেবতার পুজায় পূজারীরা তাঁকে নানা প্রকার গালা-গাল দেন। তাদের ধারণা ভর্ৎসনার মাধ্যমে তাঁকে তুষ্ট করতে পারলে তার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। প্রবীণরা একে একে শুরু করে গান।
হ্যাঁচড়া মাগীরে তোর ফ্যাচড়া চুল,
তাইতি দেবো আমরা ভাটির ফুল ॥
ভাটির ফুলি যদি না লাগে তোর মন
তাইতি দেবো আমরা মান্দার ফুল ॥
মান্দার ফুলি যদি না লাগে মন
তাইতি দেবো আমারা নীলকন্ঠ ফুল ॥
যদি না শুনিস আমার বোল
ছেড়বো আমি তোর মাথার চুল ॥
করবো তোরে ভাতার ছাড়া
ন্যাড়া মাথায় ঘুরবি পাড়া ॥
জ্বালবো আগুন তোর ঘরে
ঘা পাচড়া তুই নিবি পরে ॥
সমবেতভাবে কয়েকটি গান পরিবেশন করা হয়। এরপর একে একে কুলার ফুল গাছের গোড়ায় ঢেলে দেওয়া হয়। ফুল নিবেদনের পর শিশু-কিশোরেরা তাদের কুলা একটি লাঠি দিয়ে তালে তালে বাজাতে বাজাতে ঘরে ফেরে। এই পর আগামীকাল ভোরে ফুল তোলার নিমন্ত্রণ দিয়ে তারা ঘরে ফেরে। পরের দিন আবার যথানিয়মে আবার পুজো শুরু হয়। পুজোর শেষ অনুষ্ঠানিকতা হয় তৃতীয় দিনে। এই দিনে যে সকল আচার পালন করা হয় তা অভিনব। কুলার উল্টা পিঠে সব উপাচার সাজানো হয়।
কুলার মাথার দুই দিকে কিছুটা গোবর দিয়ে তার উপর দুটো মরা শামুক বসানো হয়। শামুকের মধ্যে দেওয়া হয় মেয়েদের মাথার কিছু ছেড়া চুল। দুটি ডেলা, ভাঁটফুলের পাতা, তেল, সিঁদুর, জল, ভোগ,বাতাসা,চিনি,নারকেল ইত্যাদি নিয়ে আসেন। বাড়ি যে কয়টি গরু থাকে সেই কয়টি ভাঁট পাতা নিয়ে আসা হয়।
ভাটি পূজায় একজন পুরোহিত থাকেন।তিনি ধূপ,দ্বীপ, নৈবিদ্য সাজিয়ে ঘন্টা,কাশি,শঙ্খ বাজিয়ে, উলুধ্বনির মাধ্যমে পূজা শুরু করেন।পূজায় শিবের মন্ত্রউচ্চারণ করা হয়।পূজা শেষে পূজারীরা ফুল,পাতা দিয়ে অঞ্জলি প্রদান করেন এবং কুলার ফুলসহ সকল উপকরণ গাছের গোড়ায় ঢেলে পার্শ্ববর্তী পুকুরে স্নান করে আসেন।প্রসাদ হিসেবে খেঁজুর গুড়ের চিনি, বাতাসা, নাড়ু নারকেল সকলের মাঝে বিতরণ করা হয়।
এরপর গাছের গোড়ায় প্রথমে তেল,জল, সিঁদুর,কাজল দেওয়া হয় এবং রোগমুক্তির জন্য গাছের গোড়ায় ঢালা ফুল,ভাটি পাতা,তেল,সিঁদুর,কাজল বাড়ি আনা হয়।
এর পর বাড়ির পুরুষরা গোয়ালের গরুগুলো পুকুরে নিয়ে গা ধোওয়ানো হয় এবং ভাঁট পাতা দিয়ে গরুর শরীরকে পরিষ্কার করা হয়।এরপর পূজা থেকে আনা তেল,জল,ফুল দিয়ে গুরুদের পূজা দেওয়া হয়।এ ক্ষেত্রে গাভী গুলোর কপালে সিঁদুর ও ষাঁড় গুলোর কপালে কাজল দেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় পাড়ার সবাই মিলে মাঙন করা চাল-ডাল-সব্জী দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া হয়।
কালের বিবর্তনে গ্রামাঞ্চলে লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনপালন ও চর্চার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হওয়ায় পূজা পদ্ধতি পালন করার রেওয়াজ কমে গেছে।