হুমায়ুন কবির কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ :
প্রতিটি নারী তার প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত কোন না কোনোভাব সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এই সংগ্রাম উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমন কি সহায় সম্বলহীন নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। ঠিক তেমনি এক সংগ্রামী নারী নিজের প্রবল ইচ্ছা শক্তির বলে সমাজকে পরিবর্তনের জন্য অসহায় দুস্থ নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। হ্যাঁ, বলছি রুমানা পারভীন রুমা নামের এক নারীর কথা। তিনি মাগুরা জেলার পৌর এলাকার কলেজ পাড়ার বাসিন্দা মৃত শামসুল আলমের দ্বিতীয় কন্যা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ২০০৫ সাথে বিয়ে হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দুলালমুন্দিয়া গ্রামের মির আমিরুল ইসলামের ছেলে মীর শরিফুল ইসলামের সাথে। সচ্ছল ব্যাবসায়ী স্বামীর সংসারে দুই ছেলেকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল রুমার।হঠাৎ করেই ধস নামে স্বামীর কনফেকশনারি ও ব্রয়লার মুরগির বড় ফার্মের ব্যাবসায়।ফলে বেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েন তার স্বামী। যার প্রভাব পরিবারের উপর এসে পড়ে। এসময় আত্মীয়-স্বজন পরিচিতজন বন্ধু-বান্ধব সকলেই রুমার পরিবারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে নিজে কিছু করার মধ্য দিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর প্রবল ইচ্ছা মনের মধ্যে জন্ম নেই রুমার। জাগ্রত ইচ্ছার প্রথম ধাপেই রুমা উদ্যোক্তার উপর ২০১৫ সালে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে স্বামী ও ভাই-বোনদের সহযোগিতায় হাতের কাজ করা নানা পণ্য ঘরে বসে নিজে ও অন্য নারী কর্মীদের দিয়ে তৈরি শুরু করেন।এসময় তার উৎপাদিত পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের বড় সমস্যা তার সামনে এসে দাড়ায়।তখন স্থানীয় দুলালমুন্দিয়া বাজারে কসমেটিকের একটি দোকান নিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন রুমা। কিন্তু যথেষ্ট পুঁজি না থাকাই ঐ ব্যবসাটি ভালোভাবে চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। মূলধনের অভাবে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, পোশাকের উপর যুব উন্নয়ন থেকে দুইবার নেওয়া প্রশিক্ষণ, বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমী থেকে মোবাইল সার্ভিসিং এর উপর নেওয়া প্রশিক্ষণ এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সেভাবে তার জীবনে কাজে আসেনি । বয়স এবং সম্পত্তির মটগেজ জটিলতায় কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে দেওয়া হয় নি ঋণ।তবুও থেমে যাননি রুমানা পারভীন রুমা। স্থানীয় অসহায় দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে “পুনর্গঠনমূলক মহিলা উন্নয়ন সংস্থা” গঠন করেন ২০১৮ সালে।তার গঠিত সংস্থায় ৩৫ জন স্থানীয় নারী সদস্য রয়েছেন। সংস্থাটি কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত।সংস্থার সদস্যদের নিয়ে তিনি স্থানীয়ভাবে বাড়ি বাড়ি যেয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী নির্যাতন, শিশু ও বয়স্কদের মানসিক বিকাশ সাধন, আত্মহত্যায় নিরুৎসাহিত করা, শিশু-কিশোরদের অধিক মোবাইল ব্যবহারের অপকারিতা এবং নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করেন। শুক্র শনিবার মাত্র দুইটি কম্পিউটার দিয়ে সম্পূর্ণ ফ্রি শিশু-কিশোর ও নারীদের বিভিন্ন ব্যাজে ভাগ করে তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। পাশাপাশি তিনি দুস্থ, অসহায় ও যুবা নারীদের জন্য দর্জি ও নকশী কাঁথা তৈরির প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। অল্প সংখ্যক বই দিয়ে নিজের তৈরি একটি লাইব্রেরির মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী ও নারীদের তিনি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করছেন।সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলা সংগ্রামী এই নারীর পাশে স্বামী ও পরিবারের লোকেরা ছাড়া অন্য কেউ বাড়ায়নি সহযোগিতার হাত ।
রুমানা পারভীন রুমার স্বামী মীর শরিফুল ইসলাম জানান, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা, পরোপকারিতা, সামাজিক কুসংস্কার, নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার প্রবল আগ্রহ লক্ষ করি।বিয়ের পর থেকেই আমি তাকে এসব কাজে সহযোগিতা করে আসছি। আমি চাই, রুমা ভালো কাজের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন করে সকলের মাঝে বেঁচে থাকুক।
রুমানার ব্যক্তিগত কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণার্থী বর্ষা খাতুন বলেন, রুমা আন্টির কারণে আমার বাবা-মা আমাকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ করানোর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। তারপর থেকে আন্টির বাসায় কম্পিউটার শিখতে আসি। মাত্র দুইটি কম্পিউটার থাকাই অনেক প্রশিক্ষণার্থীর প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য প্রশিক্ষণের জন্য কম্পিউটারের সংখ্যা বাড়াতে পারলে ভালো হতো।
রুমানা পারভীনের গড়ে তোলা “পুনর্গঠনমূলক মহিলা উন্নয়ন সংস্থা’র” সভানেত্রী মর্জিনা আক্তার নয়ন বলেন, এই সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় নারীদের সার্বিক উন্নতি বিষয়ক ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে উৎসাহিত করতে এ সংস্থার ভূমিকা অনন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নানা সংকটে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সরজমিনে রুমানা পারভীন রুমার গোড়ে তোলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেয়ে দেখা যায়, অনেক নারী দর্জি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এর মধ্যে শারমিন খাতুন নামের এক নারীর সাথে কথা হলে তিনি জানান,আমি দর্জির কাজ কিছুই জানতাম না। এখানে এসে আমি কাজ শিখেছি। আমার মত আরো অনেক মেয়ে এখানে দর্জি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
নিজের সংসার সামলিয়ে নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে আত্মসমর্পণ উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে তার চলমান সকল কার্যক্রমের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সংগ্রামী নারী রুমানা পারভীন রুমার নিকট সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমি সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করতে চাই। যেহেতু সমাজে বসবাসরত সদস্যদের অর্ধেকই নারী সেহেতু নারী সমাজের উন্নতি ঘটলে সমাজের উন্নতি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।আর্থিক সংকটের কারণে আমার সার্বিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।ব্যক্তিগত ফান্ডে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য অনেক কষ্টের। ঝিনাইদহ যশোর মহাসড়কের দুলালমুন্দিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে নিজ বাড়িতে “নকশী ঘর এন্ড অহনা টেইলার্স “নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে আমি এইসব কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ভবিষ্যতে আমার একটি গার্মেন্টস করার পরিকল্পনা আছে। যেখানে আমার সমাজের অবহেলিত নারীরা কাজ করে নিজেদের সংসার ও সমাজে ভূমিকা রাখতে পারবে। মাত্র দুইটি কম্পিউটারে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। কম্পিউটারের সংখ্যা বাড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও অর্থের কারণে সম্ভব হচ্ছে না।আমার গড়ে তোলা লাইব্রেরীতে নানা শ্রেণী পেশার মানুষের পড়ার উপযোগী বই দিয়ে গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে।সমাজের সামর্থ্যবানদের সহযোগিতা পেলে আমি আরো এগিয়ে যেতে পারতাম।
কালীগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোছাম্মৎ তাসলিমা বেগম রুমানা পারভীন রুমার কার্যক্রম সম্পর্কে জেনে তাকে সাধুবাদ দিয়ে বলেন,সমাজে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে নিজ প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানো নারীদের একজন হলেন রুমা। তিনি তার আশপাশের নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমরাও তার সকল ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান করি।কালিগঞ্জ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সংগ্রামী এই নারীর পাশে আছে , থাকবে।