সুমন হাসান কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি:
দক্ষিণ বঙ্গের ঐতিহ্য খরস্রোতা কপোতাক্ষ নদ এখন পাঁচ-ছয় ফুটের সরু খালে পরিণত হয়েছে। কপোতাক্ষ নদটি যশোর হয়ে খুলনার কয়রা উপজেলার বুক চিরে শিবসা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই নদের স্রোত আর গভীরতা নিয়ে নানা কাব্য, কবিতা প্রচলিত আছে। কপোতাক্ষ নদের বুক চিরে চলাচল করা লঞ্চ আর মাছ ধরার স্মৃতি এখনো হাতড়ে বেড়ায় ওই এলাকার মানুষ। তবে এর সবই এখন অতীত। এ নদীর দৈর্ঘ্য ১৮০ কিলোমিটার এ টি ৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বর্তমানে নদীটি খালে পরিণত হয়েছে। কয়রার আমাদী এলাকা থেকে পাশের পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার খরস্রোতা কপোতাক্ষ নদের অংশটি প্রাণ হারিয়েছে আরও আগে।
দুই বছর ধরে চলছে জরাজীর্ণ অবস্থা। এক সময়ের ১৮০ কিলোমিটার প্রশস্ত নদটি এখন পরিণত হয়েছে সরু খালে। ভাটায় সেখানে নৌকা চালানো যায় না। হেঁটেই পার হয় মানুষ। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া কপোতাক্ষের এমন মৃত্যু দেখে শঙ্কার কথা বলেছেন এলাকার মানুষ। তাঁরা বলছেন, নদটি বাঁচানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ দিন আসবে। কারণ, কয়রা উপজেলা ও পাইকগাছা উপজেলার অধিকাংশ এলাকার পানি কপোতাক্ষ নদ দিয়েই নিষ্কাশিত হয়। নদ না থাকলে ভবিষ্যতে ওই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। সরেজমিনে কয়রার আমাদী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিশাল নদটি সরু খালের মতো প্রবাহিত হয়ে কোনো রকমে টিকে আছে। নদের দুই পাশে জেগেছে বিশাল চর। সেখানে চলছে দখলের উৎসব। চর দখল করে বাড়ি ঘর থেকে শুরু করে, চিংড়ি ঘের সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কয়রার আমাদী এলাকার কপোতাক্ষের পাশেই নজরুল ইসলাম গাজীর বাড়ি। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, একসময় তাঁর বাড়ির পাশেই ছিল লঞ্চঘাট।
নদের ওপর দিয়ে নানান ধরনের নৌযান চলাচল করত। ১০-১২ বছর আগেও এই নদে প্রবল স্রোত ছিল, ছিল জোয়ার-ভাটার খেলা। কিন্তু কপোতাক্ষের দিকে তাকালে এখন সে কথা বিশ্বাস করাই কঠিন। অচিরেই সংস্কার ও খনন কাজ না করলে জলাবদ্ধতার কাল গ্রাসে চরম দূর্ভোগে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণকরেছেন। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে মসজিকুড় গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব সাঈদুর রহমান বলেন, ‘আমার যৌবনে এই কপোতাক্ষ নদেরও যৌবন ছিল চোখে পড়ার মতো। দূর থেকেই এই নদের গর্জন শোনা যেত। আমাদী তেরো আউলিয়া বাঁধের কপোতাক্ষ নদের গর্জনের কথা স্মৃতি হয়ে মনের কুঠিরে দোলা দেয়। আমি এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আর কপোতাক্ষ নদও শুকিয়ে গেছে। নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে।আমি যেমন অর্ধেক মৃত, কপোতাক্ষ নদও তেমন। আগে নদে ১৫-২০ হাত পানি ছিল। দুই বছর ধরে ভাটির সময় নৌকাও চলে না। এলাকার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম কপোতাক্ষ নদ।
কিন্তু নদের ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে চরম দূর্ভোগে পড়তে হবে এ অঞ্চলের মানুষদের। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে নদ পূনঃ খননের দাবি জানান। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সংগঠক বলেন, উপকূলীয় উপজেলা কয়রা এমনিতেই দুর্যোগের ঝুঁকিতে আছে। এরপর কপিলমুনিতে সেতু নির্মাণের নামে পিলার স্থাপন করে ২০ বছর ধরে কপোতাক্ষের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় নদটি মৃতপ্রায়। অথচ এই কপোতাক্ষ নদের প্রবাহ স্বাভাবিক না রাখতে পারলে কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষপারের মানুষের জীবন-জীবিকায় আরও বিপর্যয় নেমে আসবে। দক্ষিণ অঞ্চলের নদী গুলোতে পলি জামাতে জোয়ার ভাটার উত্থান পতন থমকে গেছে।
বৃষ্টির পানি নদে পড়তে সে পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুযোগ হারিয়ে যাওয়ায় এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নদ পূনঃ খনন কাজ দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টির জন্য দাবি জানান। লবণ পানির মৎস্য চাষের ফলে মাটির উপরের অংশ বটেই, মাটির তলদেশে ও লবনাক্ত হয়ে গেছে। এলাকার মানুষ গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানির সন্ধান পাচ্ছেন না। যার ফলে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ এখন পানির সঙ্কটে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্র জানান, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০২৪ সালের মধ্যে খুলনার পাইকগাছা বোয়ালিয়া থেকে কয়রা উপজেলার আমাদী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার কপোতাক্ষ নদ পুনঃখনন করা হবে। এ খননকাজ শেষ হলে কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। সঙ্গে সঙ্গে নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম হবে।