স্বীকৃতি বিশ্বাস, যশোরঃ
“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।”-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে রথযাত্রার কথা কবিতায় লিখেছেন, সে রথযাত্রার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেমন আছে তেমনি রথের কিছু মজার এবং আশ্চর্য করা তথ্য রয়েছে। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া আষাঢ় মাসের শুক্লা পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আয়োজিত হিন্দুদের অন্যতম প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব।
আজ রবিবার (৭ ই জুলাই /২৩ শে আষাঢ় )শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে হরিনাম সংকীর্তন, বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলি কীর্তন, আরতি কীর্তন, ভাগবত কথাসহ বিভিন্ন মাঙ্গলিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে রথ দ্বিতীয়া তিথিতে শুভ রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। রথযাত্রা হিন্দু বাঙালিদের একটি পবিত্র ধর্মীয় উৎসব।
রথযাত্রা দুটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, ‘রথ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অক্ষ, যুদ্ধযান বা কোনোপ্রকার যানবাহন অথবা চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা হালকা যাত্রীবাহী গাড়ি।এই গাড়িতে দুটি বা চারটি চাকা থাকতে পারে। সাধারণত অভিজাত শ্রেণীর ঘোড়ার গাড়িকে রথ বলা হয়। পৌরাণিক কাহিনীতে রথের ব্যবহার দেখা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সেনানায়করা রথে চড়ে নিজেরা যুদ্ধ করেছেন। যাত্রা হলো কোথাও গমন বা তীর্থযাত্রা।
আর জগন্নাথ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ “জগৎ” বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু”। “জগন্নাথ” কথাটি তৎপুরুষ সমাস। এটি “জগৎ” ও “নাথ” শব্দের সংমিশ্রণ গঠিত। যেমন “জগৎ” (যার মূল ধাতু “গম্”, অর্থাৎ “যা কিছু চলে”) এবং (“নাথ” অর্থাৎ, প্রভু বা আশ্রয়) শব্দটির সংমিশ্রণে গঠিত। সুতরাং “জগন্নাথ” অর্থ “যিনি এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আশ্রয় চলমান জগতের আশ্রয়দাতা অর্থাৎ প্রভু”।
ব্রহ্মান্ড পূরাণ অনুযায়ী, কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুর সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী দিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ ও এই অসম্পূর্ণ রুপেই পূজা শুরু করতে বলেন।
তিনটি রথ যাত্রার কিছু নিয়ম রয়েছে এবং রথের আকার, রঙেও ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন-প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চৌদ্দটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল।
তারপর যাত্রা করে বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল।
সর্বশেষে থাকে শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। রথটির আবরণের রঙ হলুদ।
তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগটি লাল রঙেরই হয়ে থাকে।
কথিত আছে, আষাঢ় মাসের শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে মাসির বাড়ি যান জগন্নাথ। মাসির বাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি। সেখান থেকে আবার সাতদিন পর মন্দিরে ফিরে আসেন জগন্নাথ। এটাকেই জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে৷ পরপর তিনটি সুসজ্জিত রথে চেপে মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে যান জগন্নাথ। এই যাওয়াকে সোজা রথ আর ফিরে আসাকে উল্টো রথ বলে।এবার
উল্টো রথযাত্রা (পুনর্যাত্রা) – ১৪ জুলাই (৩০ শে আষাঢ়), রবিবার।
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে রথযাত্রার আত্মতত্ত্বে এই রথকে মানব দেহের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে । মানবদেহের ২০৬টা হাড়ের মতো রথও ২০৬টি কাঠের খণ্ডে তৈরি হয়। রথের রশি হল মন, সারথি হল বুদ্ধি। আর এই দেহরূপ রথের রথী স্বয়ং ঈশ্বর। জগন্নাথ দেবের রথ নন্দীঘোষ বা কপিধ্বজের ১৬টি চাকা একেকটি চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানইন্দ্রিয় এবং হস্ত, পদ, গুহ্য, লিঙ্গ, মুখ (দাঁত) এই পাঁচটি কর্মইন্দ্রিয় মিলিয়ে মোট দশ ইন্দ্রিয় এবং কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ-মাৎসর্য্য এই ছয় রিপুর প্রতিনিধিত্ব করে। বলরামের রথ তালধ্বজ বা হলধ্বজের চাকার ১৪টি চাকায় ধরা থাকে মানবদেহের ১৪টি ভুবনের কথা। এই ১৪ ভুবন হল ৭টি জমি এবং ৭টি আকাশ। এই ৭ জমি বলতে মানবদেহের জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে সংযোগকারী ৭টি ইন্দ্রিয় ও ৭ আকাশ বলতে অন্তরাত্মা বা অন্তরদর্শনের সঙ্গে সংযোগকারী ৭ ইন্দ্রিয়কে বোঝানো হয়। জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ইন্দ্রিয় চক্ষু, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবং কর্ণের দুই ভাগ শ্রবণ বা শব্দগ্রহনকারী অংশ ও ভারসাম্য রক্ষাকারী অংশ এই নিয়ে মোট ৭টি। অন্তরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত ইন্দ্রিয়গুলি মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা ও সহস্রার এবং সুভদ্রার রথ দর্পদলন বা পদ্মধ্বজের ১২টি চাকাকে ১২ মাস মানবদেহের ভজনের সময়কে বুঝানো হয়।
রথযাত্রার উৎসব ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড , পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এছাড়া ইসকনের ব্যাপক প্রচারের জন্য এখন এটি বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়।ভারতের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুর শহরের মাহেশের রথযাত্রা, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ, কলকাতার রথ এবং বাংলাদেশের ইসকনের রথ ও ধামরাই জগন্নাথ রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ।
রথযাত্রা উপলক্ষে হরিনাম সংকীর্তন, বিশ্বশান্তি ও মঙ্গল কামনায় অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলি কীর্তন, আরতি কীর্তন, ভাগবত কথা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শ্রীমদ্ভাগবত গীতাপাঠ, ধর্মীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও ধর্মীয় নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে রথযাত্রা উৎসব চলবে।