দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীন পথচলার পরিবেশ নিশ্চিত হোক

লেখক: Rakib hossain
প্রকাশ: 3 months ago

মুহা. মোশাররফ হোসেন:

বাংলাদেশের অকুতোভয় ছাত্র-জনতা ও সাধারণ জনগণের অসামান্য ভূমিকায় গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে নজির বিহীন ভাবে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। দেশ এক দশকের গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন ও বাকস্বাধীনতাহীনতা থেকে হয়েছে মুক্ত। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে বিষয়ে এখন সবাই নির্ভয়ে লিখতে পারছে, কয়েক দিন আগেও যা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। এ অসম্ভবকে সম্ভব যাঁরা করলেন, সেই তরুণ সম্প্রদায় ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। এর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন পাঁচ শতাধিক ছাত্র-জনতা। গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন কয়েক হাজার। যে ঘটনা ঘটিয়েছে তৎকালীন সরকার যা প্রতিটি বিবেকবান মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এবং যার ফলশ্রোতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

দেশের প্রেক্ষাপটে নিয়ে মনে করেছিলাম আর কোনোদিন কলম ধরা হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী সরকার যেভাবে পাখির মতো গুলি করে আমার মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপর জুলুম নির্যাতন করেছে তা দেখে আমি অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলাম। সরকার পরিবর্তনের পর দেখা যাচ্ছে, থানা ও রাস্তা থেকে পুলিশ সরে পড়েছে। এমনটা দেখা গেল এবারই প্রথম।
অবশ্য পুলিশের ওপর দিয়ে যে ধকল গেছে, তাদের পুরোপুরি কাজে ফিরিয়ে আনা একটু কঠিন কাজই বটে। আবার বাহিনীটির কিছু সদস্যকে বিদায়ী সরকারের কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার ক্রীড়নক হিসেবে উৎসাহী ভূমিকায় আমরা দেখেছি।
ঐ সময়ে কি করে লিখবো.? স্বাধীনভাবে কলম ধরবার সুযোগ ছিল না সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বললেই হুমকি ধামকি ধরপাকড় শুরু হয়ে যেতো। কিন্তু এদেশ এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে ছাত্রজনতা নতুন করে স্বাধীন করেছে, হয়ত এবার বাকস্বাধীনতা ফিরে পাব সেই প্রত্যাশায় আবার হাতে কলম ধরে লিখতে শুরু করলাম।

বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরপর দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান, আহত হন, বিধ্বস্ত হয় পুলিশের অনেক স্থাপনা ও যানবাহন। তবে অতি অবশ্যই বলতে হবে, পুলিশ ছাড়া দেশ চলবে না। সামরিক বাহিনী সহায়ক শক্তি হিসেবে সাময়িকভাবে আছে। এ ক্রান্তিকালে তাদের ভূমিকাও ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ অপরাধ তদন্ত ও অনুরূপ কাজে পুলিশের বিকল্প হিসেবে তারা থাকবে না।সুতরাং পুলিশকেই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাহস ও প্রেরণা দিতে হবে।

জনগণের ভবিষ্যৎ অধিকার চিন্তায় মাথায় রেখে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’কে জাতিসংঘ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছে। তাই তারা আগামী দিনের মতপ্রকাশের অধিকারকে সব ধরনের অধিকারের অন্যতম পরিচালিকা হিসেবে মনে করছে গণমাধ্যম দিবস। আমাদের দেশের সংবিধানে বর্ণিত ৩৯ ধারায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। দেশের প্রচলিত সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচার ও বহুল ব্যবহার জনগণকে একরকমের স্বস্তি দেয়। গণতান্ত্রিক চর্চায় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ভূমিকা ব্যাপক। এসব মাধ্যম তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও নীতি বজায় রেখে প্রকাশিত হবে এটাই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু যদি তাহাতে বাঁধা আসে বা ব্যত্যয় ঘটে তখন গণতন্ত্রের যাত্রার সমস্যা সংকুল হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম একে অপরে হাত ধরাধরি করে চলে। এর যেকোনো একটি আরেকটির পরিপূরক।

ইতিপূর্বে আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে দীর্ঘদিন এক সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে গণতন্ত্রের অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল। একই সঙ্গে গণমাধ্যমের ভাগ্যেও জুটেছিল নানা প্রতিবন্ধকতা কখনো প্রকাশ্যে, কখনো অপ্রকাশ্যে। ইতিহাসের পাতা ওলটালে এই উদাহরণ অনেক দেখা যাবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম শেখ হাসিনা সরকার থাকাকালীন অনেক অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি। বর্তমান এই ছাত্রজনতার আন্দোলনের পরে নতুন করে স্বাধীনতা পেয়ে সে আলোচনায় আমরা আর নাই বা যাই।

গণতান্ত্রিক সমাজের বড় অহংকার হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া। গণতান্ত্রিক চর্চায় আমাদের অভিজ্ঞতা খুব সুখপ্রদ নয়। সব সরকারই তাদের নিজেদের সুবিধাজনক একটা পরিবেশ তৈরি করতে চায়, যা নাকি মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশকে সংকীর্ণ ও ঘোলাটে করে তুলে। তারা শুধু তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বুঝতে চায়, সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনে না। গণতন্ত্রের অন্যতম শিক্ষা সহজভাবে আমরা বলতে পারি জনগণ যেটা কারোর হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজে নিজেই মত প্রকাশ করতে পারবে। জনগণের এই স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্রের যাত্রা সুখকর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের অন্তর্নিহিত বক্তব্য ও চেতনা অবশ্যই বাধাবিপত্তিহীন গণমাধ্যমের পেশাগত চর্চা অব্যাহত রাখা। সাংবাদিকেরা যখন তথ্য সংগ্রহ করে সংবাদ লিখতে বসেন, তখন তিনি পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের কথা মাথায় রেখে তা লেখেন, তখন কিন্তু তাঁর মাথায় উদ্দেশ্যমূলক কোনো বিশেষ রাজনীতি, সরকার কিংবা কোনো বিশেষ শক্তির কথা ভাবনায় থাকার কথা নয়। তবে, পেশাগত নৈতিক, আদর্শিক ও আইনি প্রেক্ষাপট তার মাথায় থাকে বা থাকতেও হয়।

নতুন ছাত্রজনতার আন্দোলনে স্বাধীন হওয়ার পরে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের কারণে গণমাধ্যমের একধরনের উন্নয়ন ও রূপান্তর ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কম-বেশি সব মাধ্যমেই প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে মানুষের জীবনে বড় রকমের প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটের যে সমাস্যা ছিল সেই সমাস্যা দুরিভূত হয়ে ইন্টারনেট সচ্চলের কারণে প্রায় সব বয়সের মানুষের পেশায় ও জীবনের মান উন্নয়নে গভীর ভূমিকা রেখে এবং তাদের জীবনাচরণ পাল্টে যেতে দেখা যাচ্ছে। ইন্টারনেট মানুষকে অনেক বেশি প্রকাশমুখী করে তুলেছে; বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে যে কেউ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে। ইতিপূর্বে মানুষ এত বেশি মনের ভাব প্রকাশ করার সুযোগ পেত না, কিন্তু এখন সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপকতার ফলে তারা যেকোনো বিষয়ে একই সঙ্গে কিংবা পৃথকভাবে পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা বা মতামত দেওয়া অথবা শেয়ার করার সুযোগ পাচ্ছে। অনেক বিষয় দৃষ্টিগোচর করতে পারছে, এমন কিছু নেই যে আজ অপ্রকাশ্য থাকছে।
ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির অগ্রসরতায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। জনগণের আইনগত নিরাপত্তা ও সুবিধা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম সংস্থাগুলোর স্কোরে ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্ত সংবাদপত্রের অবস্থান। দেখা যাচ্ছে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল এদেশে, জনগণ তার সুফল না পেয়ে বরং নির্যাতিত হয়েছে, সাংবাদিকেরা এর মধ্যে অন্যতম। এই আইনকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে অবিলম্বে প্রশ্নবিদ্ধ ধারাগুলো পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আইনের পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম, সম্প্রচার, সাংবাদিকতা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন, যার মধ্যে কতিপয় আবার নতুন করে প্রণয়নের পথে রয়েছে, এগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্টজন ও প্রতিষ্ঠানের মতামত নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। যেকোনো দেশে প্রযুক্তিবান্ধব আইন এবং সেসব আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
আমরা চাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশ অব্যাহত থাকবে। দায়িত্বশীল পেশাগত আচার-আচরণ এবং সমাজের কল্যাণে অঙ্গীকার যেকোনো গণমাধ্যমের জন্য পালনীয়। মানুষের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীন পথচলার পরিবেশ নিশ্চিত হবে এটাই আমার কাম্য।

পাশাপাশি প্রতিহিংসা চাই না। চাই আইনের শাসন ও জনমানুষের নিরাপত্তা। কেউ অন্যায় করলে তার বিচার হতে হবে আইনের মাধ্যমে। সে জন্য সংবিধানসহ যে যে ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, তা করতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। দেশের মানুষ এখন আইনের শাসন ও নিরাপত্তা চায়। আর একটা সহিংসতার ঘটনা, একটা মৃত্যুও কাম্য নয়।

বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মন্দির পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে দেখা গেছে তাঁদের। অনেক মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। এই তরুণ প্রজন্মের আদর্শের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কারা এসব সহিংসতা ঘটাচ্ছে ও লুটপাট করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এই গণ-অভ্যুত্থান তাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশা জুগিয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী এবারও যেন তাদের আশাভঙ্গ না হয়। এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

error: Content is protected !!